দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

একুশে ফেব্রুয়ারি—ভাষা শহীদ দিবস— আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

এ নিয়ে রচনা লিখতে আর চাই না। তবে পড়ি, যা কিছু লেখা সব পড়ি। পড়তে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। মাফ করবেন। এটা আমার ছোটবেলায় স্বভাব। পড়তে বসলে ঘুম পায়। একটা কথা বহুল প্রচলিত-লিখতে গেলে পড়তে হয়। আর যেহেতু পড়তে গেলে ঘুমিয়ে পড়ি তাই কোনো কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে কিনা ঘুমের ঘোরে মগজে অনেক কথা গিজগিজ করে। কথাগুলো এরকম—

ইংরেজি ভাষা আয়ত্তে করার দিকে আমরা যতটা মনোনিবেশ করেছি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ পদ্ধতি বা বানান পদ্ধতি নিয়ে ততটা মনোযোগ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই ইংরেজির Nesfield বা Guide to spelling and pronunciation এর মত বইকে যত গুরুত্ব দিই, বাংলাভাষায় ঐ ধরণের বইকে তত গুরুত্ব দিইনা। এর প্রতিকার প্রয়োজন।

"২০০০ সাল থেকে বিশ্বের প্রায় ১৯৩টি দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। বিশ্বে এথনোলগ-এর বিংশ সংস্করণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ছয় হাজার থেকে আট হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা স্বমর্যাদায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে আছে।"

"বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র এমনকি পৌঁছে গিয়েছে মহাকাশেও।" 

"আফ্রিকানরা গাইছে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো..."

বাংলা ভাষাকে ভালবাসা আর মর্যাদা দিতে একটিদিনই যেন যথেষ্ট। না, সকলের ব্যাপারে এক বাক্যে একই কথা অবশ্যই বলা যাবে না। তবে প্রয়োজন। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে গুরুত্ব দেওয়া, বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার উচ্চারণ কোষের বিশেষ প্রয়োজন।

প্রয়োজন মৌখিক ভাষাকে পরিশীলিত করার, যেহেতু লিখিত ভাষা মুখের ভাষার কাছাকাছি আসুক এটাই কাম্য। নাটকে চরিত্র বিশেষের রূপ দানের জন্য সেটি না হলেও তবু চলে।

ভাষা সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে বানান সংস্কারের অবশ্যই প্রয়োজন। শিখে আয়ত্ত করাই বাঞ্ছনীয়।

আর, বাংলাভাষা পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মাতৃভাষা। ভাষা সমস্যা সমাধানের উপায় উভয়কে একযোগে স্থির করতে হবে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সেই দেশের মানুষকে মুক্তি দেওয়া ভালো যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, রাষ্ট্রভাষাও নয়। 

শুনেছিলাম পৃথিবীর বুকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ ব্যতীত আরও একটা দেশ আছে যাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারত থেকে আকাশ পথে ন'হাজার সাতশ আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম আফ্রিকায় আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত অসংখ্য খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ যাকে 'হীরার খনির গরিব দেশ' বলা হয়ে থাকে সেই সিয়েরা লিওনের (আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার) ৬০ লাখ দরিদ্র ও অসুখী মানুষের দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হল বাংলা। দীর্ঘদিন এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। এ উপনিবেশটি গড়ে তোলা হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুক্ত ক্রীতদাসদের নিয়ে। এরা সবাই ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। ১৯৬১ সালে সিয়েরা লিওন ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমানে সিয়েরা লিওনের সাংবিধানিক নাম সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র।

১৯৯১- ২০০২ সাল পর্যন্ত সিয়েরা লিওন সাক্ষী ছিল গৃহযুদ্ধের। ২০০২ সালের ১৮ই জানুয়ারি লড়াই এর অবসান ঘটাতে বাংলাদেশ থেকে আগত জাতি সংঘের (UN) ৫৩০০ শান্তিরক্ষী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। যুদ্ধ সমাপ্তির পর সিয়েরা লিওনের অত্যন্ত অনিশ্চিত অবস্থা স্থিতিশীল করতে গণপূর্ত প্রকল্পে  সহায়তা করেছিল বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা। ফল স্বরূপ কৃতজ্ঞতা বশত ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে সিয়েরা লিওনের তৎকালীন  রাষ্ট্রপতি আহমেদ তেজান কাব্বাহ্ বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দান করেন। তখন কিছু স্থানীয় মানুষ ধন্যবাদ জ্ঞাপনের প্রতীক হিসেবে বাংলা ভাষা শিখেছিলেন। কিন্তু সেখানকার  বহুল প্রচলিত স্থানীয় ভাষা 'ক্রিও' বা 'কিরিও' (broken English)। এছাড়া সেখানে মেন্দে, তেমনে  ভাষা প্রচলিত রয়েছে। তাছাড়া কোনো, কুরাঙ্ক, কিসসি, ফুলা, লিম্বা ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছে। আরও কয়েকটি বিলুপ্ত প্রায় ভাষা রয়েছে যেমন ক্রিম, বোম, সেরব্রো।

পরিশেষে বলি, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী সবাই বাংলাভাষী নন। উত্তরে নেপালি এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে সাঁওতালি ভাষাভাষীদের মাতৃভাষার চর্চা কিভাবে হবে, যে সব অবাঙালি মানুষ জীবিকা বা অন্যান্য প্রয়োজনে এখানে এসেছেন বা পুরুষাক্রমে বাস করছেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ কোন ভাষায় হবে - এগুলি বিবেচ্য। 

তবে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা বা পৃথিবীর অন্তত একটি রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা যে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পেয়েছে এটা আমাদের খুবই আনন্দের ও গৌরবের বিষয়।

(www.theoffnews.com - World wise Bengali)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours