ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

আগামীকাল আমাদের ট্রেনিং শেষ হচ্ছে। এক মাস অনেক কষ্ট গেছে শরীরে। আগামীকালের ট্রেনিংটাও নাকি অনেক কষ্টের। তা হোক। ট্রেনিং শেষ হলেই আমরা বাঁচি। তাহলে আমরা দেশে ফিরতে পারবো। দেশে কি হচ্ছে তুরার ট্রেনিং ক্যাম্পে বসে আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। সবাই দেশে ফিরতে মুখিয়ে আছে। সবারই এক কথা, কবে ফিরবো দেশে, কবে শত্রুর মুখোমুখি হবো। 

রাতে তাবুতে অনেক আনন্দ করলাম আমরা। গান চললো বিরামহীন। কালিয়া হরিপুরের হামিদ ভাই নজরুল গীতি গাইলেন। রায়গঞ্জের আশরাফ ভাই মান্না দে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গাইলেন মিষ্টি সুরে। মান্না দে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান এর আগে আমি কোনদিন শুনিনি। আশরাফ ভাইয়ের কণ্ঠে প্রথম শুনলাম। বাড়িতে গান শোনার কোন সুযোগ ছিল না। গ্রাম-গঞ্জে মাইকে যে গান শুনতাম তার বেশির ভাগই আব্বাস উদ্দিনের ভাওয়াইয়া আর পল্লিগীতি। সত্যি বলতে কি, হেমন্ত, মান্না দের নাম আমি প্রথম শুনলাম যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে এসে। গান গুলোর কি চমৎকার কথা আর সুর। তারউপর কি মিষ্টি কণ্ঠ। ভাল লাগতে লাগতে মন উদাস হয়ে যায়। শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। আশরাফ ভাই আমাদের সেকশন কমান্ডার। বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানায়। দারুন অমায়িক মানুষ। পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। একজন নামকরা ফুটবলার। ভাল খেলোয়াড় হিসেবে রায়গঞ্জ অঞ্চলে তার ব্যাপক পরিচিতি। ভীষণ জনপ্রিয়। আমি তাঁর গান শুনে ভীষণ ভক্ত হয়ে যাই। ফাঁক পেলেই আমি তাঁকে গান গাইতে অনুরোধ করি। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, তাতে তিনি একটু বিরক্ত হন না। নিচুগলায় ঠিকই গান গাইতে থাকেন। আমাকে তিনি বেশ পছন্দ করতেন। 

বয়সে তিনি আমার সিনিয়র হলেও সহজ ভাবে বন্ধুর মতো মিশতেন। যে কাউকে সহজে আপন করে নেওয়ার প্রবল আন্তরিকতা ছিল তাঁর মধ্যে। মুখে কদম ছাট দেওয়া চাপ দাড়ি। সেই দাড়িতে তার ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটেছে উজ্জ্বল্যময়। মিষ্টি ভাষী। কথা বলেন মৃদু কণ্ঠে। সেই মৃদু কণ্ঠে যখন গান ধরেন তখন সেই কণ্ঠ ভরাট কারুকার্যময় হয়ে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা তখন মন্ত্র মুগ্ধের মতো  শুনি।  

পরদিন শেষ ট্রেনিং শুরু হলো বেলা দশটার দিকে। পাশাপাশি ৩০জন যোদ্ধা হাতে রাইফেল নিয়ে ক্রলিং করে এগুবে। জায়গাটা চিক-চিক কাদা। সামনে উঁচু মতো জায়গায় ১০টি এলএমজি ফিট করা। দশটি এলএমজি থেকে ক্রমাগত ফায়ার হতে থাকবে। আর আমরা ফায়ারের নিচ দিয়ে রাইফেল হাতে ক্রলিং করে এগুতে থাকবো। মাথা তুললেই ভবলিলা শেষ। 

এই ট্রেনিংয়ের অর্থ হলো যুদ্ধের সময় শত্রুর গুলির মধ্যে কিভাবে ক্রলিং করে এগুতে হবে, কিভাবে নিরাপদ পজিশনে যেতে হবে এটা তারই ট্রেনিং তার জন্য সাহস তৈরি। 

তৃতীয় ব্যাচে আমার পালা এলো। একসঙ্গে ত্রিশজন যোদ্ধা আমরা মাটিতে শুয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে দুই হাতের উপর রাইফেল ধরে ক্রলিং শুরু করলাম। জায়গাটা থকথকে কাদা। আমরা ক্রলিং শুরু করা মাত্র সামনে থেকে ১০টি এলএমজির ব্রাশ ফায়ার শুরু হলো। ভয়ংকর শব্দ। কানে তালা ধরে আসে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছেনে তাকিয়ে দেখি গুলি পাহাড়ের গায়ে লেগে মাটি ছিটকে উঠছে। গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ছে। হাত দশেক যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম এই দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া ভীষণ কঠিন। কাদার মধ্যে কুচি কুচি পাথর। হাতের কনুই এবং হাঁটুর চামড়া ছুলে ছ্যাড়াবেড়া হয়ে যাচ্ছে। কনুইতে ভর দিতে পারছি না। কনুই কাদা মাটিতে ফেললেই চিড়িক দিয়ে যন্ত্রণা মগজে গিয়ে চিবিয়ে ধরছে। প্রায় দুইশ গজ পথ আমাদের ক্রলিং করে গন্তব্যে পৌছতে হবে। ৫০গজ যাওয়ার পর আর পারছিলাম না। চিৎ হয়ে শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। প্রবল যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ের কথা স্মরণ করলাম। মায়ের কথা স্মরণ হতেই মনে সাহস বেড়ে গেল। আবার ক্রলিং শুরু করলাম। আমাকে পারতেই হবে। না পারলে মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করবো কিভাবে? আমার সঙ্গিরা কেউ কেউ বেশ এগিয়ে গেছে। আমিও দাঁতে দাঁত চেপে সামনে ছুটতে লাগলাম। কখনও কখনও কনুই কাদায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার মগজে গিয়ে চিহ্নিত করে যন্ত্রণা খামচে ধরছে। সে যন্ত্রণা অসহনীয়। সামনে আর মাত্র ২০গজ। কিন্তু সেই ২০গজকে ২০ মাইল মনে হচ্ছিল। পথ যেন ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। সেই ২০গজ এগুনোর চলৎশক্তি তখন শরীর থেকে হারিয়ে গেছে। তারপরও যেতে হবে। উপায় নেই। মনে মনে জয়বাংলা বলে অবশেষে পাহাড় ডিঙ্গালাম। গন্তব্যে পৌঁছে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার আগে যারা পৌঁছেছে তারাও শুয়ে আকাশ দেখছে। সবার চোখে মুখে যন্ত্রণার ছাপ। কেউ কেউ মৃদু স্বরে আঃ উঃ করছে। কনুই এবং হাঁটু এমনভাবে ছিলে চামড়া উঠে মাংস বেরিয়ে পড়েছে। দেখলেই ভয়ে গা শিউড়ে ওঠে। 

তারপর আমরা দলবেঁধে ঝর্ণায় গোসল করতে গেলাম। কাদামাটিতে সবাইকে গুহাবাসী আদিম মানব মনে হচ্ছিল। চেনা যাচ্ছিল না কাউকে। 

দুপুরের খাওয়ার পর বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। শরীর একেবারে ছেড়ে দিল। শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। সারা শরীর কিটকিটে ব্যথা। তবে বিশ্রাম হলো বেশ। বিকেলে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখি পা জোড়া আমার কথা শুনছে না। যন্ত্রণায় পা জোড়া টেঁসে আছে। শরীরের ভর পায়ের উপর রাখা যাচ্ছে না। এই সমস্যা শুধু আমার একার নয়। যারা গেরিলা ট্রেনিং করেছি সবারই একই অবস্থা। অগত্যা হাসপাতালে গেলাম বন্ধু আসগরের সঙ্গে। গিয়ে দেখি লম্বা সেখানে লাইন। সবাইকে ব্যথার একই দাওয়াই টেবলেট এবং মলম দিয়ে বিদায় করছে। আমাদেরও তাই দেওয়া হলো।

পরের দিন রেস্ট। রাতে কমান্ডার পান্না আই সবাইকে একটি ভয়াবহ দুঃসংবাদ জানালেন। বললেন, ‘ট্রেনিং শেষ হয়নি। ফাইনাল ট্রেনিংয়ের জন্য পরশু দিন আমাদের ঘন জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। কারো সঙ্গে কোন খাদ্য খাকবে না। পাহাড়ি ফলমূল সংগ্রহ করে খেতে হবে। সেই ট্রেনিং চলবে তিনদিন। এর নাম গেরিলা ত্রেনিং।’ 

শুনে মনটা অস্থির হয়ে গেল। ট্রেনিংয়েই যদি জীবন পার করে দেই তাহলে যুদ্ধ করবো কবে? রেস্টের দিন তাবুতেই কাটলো সারাদিন। বিকেলে ভাবলাম চানরিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসি। আর যদি দেখা করার সুযোগ না পাই। কিন্তু শরীরের যা কন্ডিশন তাতে একা যেতে সাহস হলো না। বন্ধু আসগরকে বলতে লজ্জা করছিল। ও জানে না, ওই পাহাড়ি গ্রামের মিষ্টির হাসির মেয়েটি আমাকে আলাভোলা করে দিয়েছে। মিথ্যে বলেও আসগরকে নেওয়া যেত। কিন্তু ও থাকলে আমাদের কথাতো জমবে না। উল্টো বন্ধু আমার ক্ষেপে যেতে পারা, ‘এই তোর আক্কেল পছন্দ? তুই কি যুদ্ধ করতে এসেছিস না প্রেম করতে এসেছিস? এটা কই প্রেমের সময়?’ আমি কল্পনায় বন্ধুর মুখে এমন ডায়লগ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাই যাওয়া ক্যানসেল করলাম। 

জঙ্গল ট্রেনিংয়ের আগের রাত নির্ঘুম কাটলো। সারারাত শুধু চানরিয়ার কথা মনে দাগ কাটতে লাগলো। আর কি কোনদিন আমাদের দেখা হবে না? একজীবনে এই কি আমাদের শেষ দেখা? [চলবে] 

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours