ইসহাক খান, মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ:

আমরা যে নৌকায় উঠলাম সেগুলো মূলত মাল বহনের জন্য ব্যবহৃত নৌকা। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় এ নৌকাকে বলে বজরা নৌকা। বিশাল আকৃতির সেই নৌকা। ছোটখাটো লঞ্চ বলা যায়। ছইয়ের ভেতর অনেক জায়গা। পার্টিশন করে রুম ভাগ করা। আমরা যে নৌকায় উঠলাম সেখানে আমরা ছাড়া আরও দু’টো পরিবার যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। তারা হিন্দু সম্প্রদাইয়ের মানুষ। পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়ে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে যাচ্ছে। পাকিস্তানি মিলিটারি হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী পেলে কিছুতেই ছাড় দিচ্ছে না। এই

দুই ধরণের মানুষকে বেছে-বেছে তারা মেরে ফেলছে। এদের জন্য দেশ ভীষণ অনিরাপদ হয়ে হয়ে উঠেছে। দুই পরিবারের বাবা-মা ছাড়াও যুবক বয়সী তিনজন ছেলে মেয়ে ছিল। আর ছিল বালক এবং শিশু  বয়সী দু’তিনজন। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নৌকার ভেতরে থাকতাম, খেতাম এবং ঘুমাতাম। 

আমরা পাশাপাশি দু’নৌকায় ভাগ হয়ে গেলাম। একই মালিকের দু’নৌকা। থাকা খাওয়ার সুবিধের জন্য আমরা নয়জন দুভাগ হয়ে দু’নৌকায় চড়লাম। একভাগে আমি, আসাদুজ্জামান খোকন, সাইফুল ইসলাম মিন্টু, শাজাহান, সরকার আলী আসগর। অন্যটিতে রফিকুল আলম সুকুর, মোস্তফা, জহুরুল ইসলাম খান এবং আব্দুর রাজ্জাক খান [মোটা রাজ্জাক]। 

পাকিস্তানি মিলিটারিদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য নৌকার সামনে কয়েকটি ভুসি মালের বস্তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে দূর থেকে পাকিস্তানিরা দেখলে বুঝতে পারে নৌকায় মালামাল বহন করা হচ্ছে। অথচ নৌকার ভেতরে আমরা আরও দু’টো পরিবার এবং দুই পরিবারের যুবক যুবতী বালক বালিকারা ঘাপটি মেরে আছি। আমাদের সতর্ক করা হয়েছে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত বিপজ্জনক এরিয়া। এই সময় কিছুতেই ছইয়ের বাইরে যাওয়া চলবে না। 

দালালের কাছে আমরা আগেই জেনেছি আমাদের ভারতে পৌছতে তিনদিন লাগবে। পথে খাওয়া-দাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেন আমরা সংগ্রহ করে তবেই যাত্রা করি। সেই মতো আমরা আগেরদিন বিকেলে স্থানীয় ‘পাকিস্তান হাট’ থেকে চাল-ডাল আলু পেঁয়াজ তরি-তরকারি কিনে নিয়েছি। নৌকার ভেতরে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা আছে। মাটির তৈরি বহনযোগ্য চুলা আর লাকড়ি এগুলো নৌকার মাঝিদের সংগৃহীত। আমরা সবাই সেটা ব্যবহার করছি। কাকিমারা রান্না করার পর আমাদের রান্নার আয়োজন শুরু হতো। আমাদের পর মাঝিরা। তারা সংখ্যায় ৮ জন। 

আমাদের রান্নার কাজে সাহায্য করতো বুড়ি। বুড়ি কলেজ পড়ুয়া আমার বয়সী একটি মেয়ে। আমিও কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বুড়ি আমার ইয়ারমেট। 

দুই পরিবারের মধ্যে শুধু বুড়ির নামটা এখনও মনে আছে। নিশ্চয়ই তার পোশাকি কোন নাম ছিল। কিন্তু সেটা জানা হয়নি। বুড়ি সিরাজগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে পড়তো। মাঝারি গড়নের শ্যামলা মেয়েটি মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে আমাদের সবার মন জয় করে নিয়েছিল। যেন আমরা আপন ভাইবোন। এতো গুলো বছর পরও বুড়ির কথা হৃদয়ে গেঁথে আছে। সেই যে দেশ ছেড়ে গেলাম তারপর আর কখনও বুড়িদের সঙ্গে আমার বা আমাদের কখনও দেখা হয়নি। আমার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হউয়ার কথাও জানতে পারিনি। জানি না বুড়িরা কোথায় কেমন আছে?             

বুড়ির নামটা মনে থাকার আরও একটি বড় কারণ হলো আমাদের রান্নার দায়িত্বে ছিল শাজাহান। যিনি পেশায় তাঁতশ্রমিক। যার ভারত যাওয়ার নৌকা ভাড়া আমাদের দিতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে একমাত্র সেই বিবাহিত। আমরা তাকে বলতাম ম্যারিড ব্যাচেলর। বিয়ে করেছে কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে একঘরে থাকার সুযোগ হয় না। বাড়িতে বাড়তি ঘরের অভাব। শশুর বাড়িতেও একই সনস্যা। এই নিয়ে তার ভয়ংকর খেদ। রাগে দুঃখে তার নাকি মরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই শাজাহান কথা বলতো ভীষণ দ্রুতলয়ে। কথা অনেক সময় জড়িয়ে যেত। সে রান্নার সময় বুড়িকে দ্রুতলয়ে কয়েকবার নাম ধরে ডাকতো। আর এই ব্যাপারটা নিয়ে রসালো ভাবে মজা করতো আসাদুজ্জামান খোকন। অবিকল শাজাহানের কণ্ঠে বুড়ি-বুড়ি-বুড়ি বলে ডেকে শাজাহানের সঙ্গে রঙ্গ তামাশা জুড়ে দিত। বলতো বুড়ির সঙ্গে শাজাহানের গভীর প্রেমপর্ব

চলছে-আমরা সেই তামাশা ভীষণ উপভোগ করতাম। শাজাহানকে এই নিয়ে কখনও মন খারাপ করতে দেখিনি। ভেতরে ভেতরে সেও এনজয় করতো। 

বুড়ি এবং তার দাদাদের অধিকাংশ সময় আলাপের বিষয় থাকতো ভারতে পৌঁছে তারা কিভাবে কলকাতা যাবে। কলকাতায় তাদের আত্মীয় আছে। তারা সেই আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠবে। কলকাতা যাওয়া নিয়ে তারা ভীষণ চিন্তিত। 

আমরা জেনেছি আমাদের নৌকা ভারতের আসাম রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষা ছোট শহর মাইকেরচর গিয়ে আমাদের নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে আমরা তিন/চার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ভারতের পেটের ভেতর বাংলাদেশের রউমারি থানা, আমরা সেখানে যাব। সেটা মুক্তাঞ্চল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাইমারি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

আমরা উভয়ই যার যার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য উতলা। রাত এলে সময়টা ভীষণ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। রাতে নৌকা চলে না। নদীর ধারে কাশবনের ভেতর কোন নিরাপদ জায়গায় নৌকা ঢুকিয়ে দিনের জন্য অনন্ত অপেক্ষায় থাকি আমরা। কখন ভোর হবে। কখন আবার যাত্রা হবে। কবে পৌঁছবো কাঙ্খিত স্থানে। [চলবে]

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Bangladesh muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours