মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

ছোটোবেলায় প্রথম ইতিহাস পড়া মানেই সন্ধ্যেবেলায় (প্রায়ই হ্যারিকেনের আলোয়) মা গল্পের মত বলে যাবে, আর আমি শুনে যাব চোখ বনধ করে। পরদিন ভোর পাঁচটায় উঠে মায়ের মুক্তোর মত হাতের লেখায় মোটা লম্বা  চওড়া একটা খাতায় রাতের বিষয়টিই প্রশ্ন উত্তর ছলে লেখা হিসেবে পাব। আমার কাজ ছিল সেগুলো মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেওয়া। সেই ভাবেই  কোনোদিন পাঠ্য বইয়ের পাতা না উল্টেও সব সময় কি করে যেন ক্লাসে সর্বোচ্চ মার্কসও পেয়ে যেতাম। প্রেম ছিল বিজ্ঞান আর অঙ্কের ওপর, তাই মাধ্যমিকে  ইতিহাসে অনেক নম্বর থাকা সত্তেও আর মায়ের একান্ত ইচ্ছে থাকলেও বিজ্ঞানকেই বেছে নিয়েছিলাম পরবর্তী উচ্চতর শিক্ষার জন্য। আজ এই বুড়ো বয়সে বুঝছি মায়ের মুখে শোনা সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস, স্যার রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম, হরপ্পার সেই স্নানাগার মনের কোণে গভীরভাবেই রেখাপাত করেছিল। ভালবাসার গোপন ফল্গুধারাটিকে টের পাইনি বিজ্ঞানের প্রতি অন্ধ ভালবাসায়। মায়ের নির্বাচিত পাত্রটিও মানে আমার কর্তাও বড়ই ইতিহাস প্রেমিক। স্বামীর কর্মসুত্রে বর্তমানে গুজরাটবাসী। তাই হঠাৎই দুজনে মিলে ঠিক করলাম কচ্ছের ধোলাভীরা আর লোথাল যেখানে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে সেটা দেখেই আসা যাক। তাই নিজেদের গাড়ী নিয়ে গত ২৬শে ডিসেম্বর গেলাম লোথাল আর ৩১শে ডিসেম্বর এজেন্সী থেকে গাড়ী নিয়ে  গেলাম ধোলাভীরা।

লোথাল জায়গাটি আহমেদাবাদের ধোলকা অঞ্চলের সরগওয়ালা গাঁয়ের ২ কিমি দুরে অবস্থিত একটি ছোট্ট গাঁ। লোথাল শব্দের অর্থ মৃতের টিলা। এখানে খ্রীষ্ট পূর্ব ২৫০০ -১৯০০ সময়কার হরপ্পান যুগের ব্যবহৃত প্রচুর সামগ্রী উদ্ধৃত হয়। একসময় লোথাল ছিল বন্দর নগরী---সমুদ্র খুব কাছেই থাকায় মালবাহী জাহাজের আনাগোণা চলতেই থাকত। এখানে বিশাল এক গুদাম ঘর পাওয়া গেছে। এককালে এখানে দূর্গ ছিল যার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ছিল এই গুদাম ঘর। এই গুদাম ঘরটিই এখানকার সবচেয়ে উল্লেখনীয় জিনিস। এটি ৩.৫ মিটার উঁচু মাচার উপর করা। ৪৯ বাই ৪০ মিটার মাপ ছিল এই গুদাম ঘরের। মালবাহী জাহাজ থেকে জিনিস নামিয়ে সুরক্ষিত ভাবে রাখা হত এই গুদাম ঘরে। ৬৪টা পাকা মাটির স্তম্ভের ওপর কাঠের ছাউনি দিয়ে ঘেরা ছিল এই গুদাম ঘর। হরপ্পা নগরীর লোকেদের লোথালে বাণিজ্য করতে আসার প্রধাণ কারণ ছিল কাছেই নদী থাকায় প্রচুর চাল আর তুলো উৎপন্ন হত এই লোথালে।

এখানে তামা, কাঁসা, শঙ্খের, সেমিপ্রেসিয়স স্টোনের প্রচুর জিনিস পাওয়া গেছে। বোঝাই যায় এ সবই রপ্তানী হত হরপ্পার বড় শহরে ও মেসোপটেমিয়ায় {বর্তমানের ইরাকে}। সুমেরীয় মানুষের মুখের মত পোড়া মাটির মানুষের মুখ, টেরাকোটার গরিলা, এমন কি মিশরের মমিও পাওয়া গেছে লোথালে। এখানে মাটি খুঁড়ে একটি কবর থেকে জোড়া নর নারীর কঙ্কাল পাওয়া গেছে, যেখানে নারীর হাতে শাঁখা,পলার মত চুড়ি আর মৃতদের জন্য রাখা পোড়া মাটির জলের পাত্রও পাওয়া গেছে। মনে হয় মমি বানানোর গুপ্ত রহস্য এদেরও অজানা ছিল না। খ্রীষ্ঠ পূর্ব ১৯০০ শতকে ঘনঘন নদীতে বন্যা হওয়ায় লোথাল নগরী শেষ হয়ে যায়----এরপর খ্রীষ্ঠ পূর্ব ১৭০০'র সময়ে পুরোপুরি মনুষ্য পরিত্যক্ত নগরী হয়ে যায় লোথাল। প্রফেসর এস আর রাও মহাশয়ের তত্ত্বাবধানেই ১৯৫৫ সালে খননকার্য চলাকালীন ভারতবর্ষের লোথালে  পাওয়া যায় হরপ্পান সভ্যতার নিদর্শন আর প্রচুর তদানীন্তন মুদ্রা। লোথালের আর্কিওলজিকাল মিউজিয়ামটিতে কাজ চলছে তাই বন্ধ আছে কিছুদিন ধরে।

এরপর আসি ধোলাভীরার কথায়---বিশাল জায়গা জুড়ে ১৩টা সেশনে এখানে খননকার্য চলেছে। ৬০ হেক্টর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন। গাইডের কাছ থেকে জানলাম আগে এই জমির ওপর সাইকেল চালিয়েছে তার বাবা, কাকারা। কোনো এক বছর অনাবৃষ্টিতে চাষের হাল ছিল বড়ই খারাপ, সরকার থেকে সাহায্য হিসেবে কিছু লোককে দিল মাটি খোঁড়ার কাজ। এসময় একজনের হাতে পড়ল ইউনিকর্নের মুখ আঁকা মুদ্রা। এর আগে পোড়া মাটির পাত্র, চুড়ি ঘড়া এসব প্রায়ই পেত স্থানীয় গ্রামবাসীরা, আর দিব্যি বাড়ী নিয়ে গিয়ে ব্যবহারও করত। কিন্তু মুদ্রার খবর পেয়ে ১৯৬১ সালে নড়েচড়ে বসলেন শ্রীজগৎপতি যোশী। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ সাল অবধি জায়গাটি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দিলেন তিনিই। এরপর ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হল প্ল্যান মাফিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য আর এস ভিস্তের তত্ত্বাবধানে, চলেছে২০০৫ সাল অবধি। বর্তমানে এর দায়িত্ব নিতে চলেছে ইউনেস্কো, ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট বলে ডিক্লেয়ারও করার কথা চলছে।

সিন্ধু নদী আর সরস্বতী নদীর দুপাশে খ্রীষ্ঠ পূর্ব ৩০০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল নদীমাতৃক এক সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা! সে সময়ের পাঁচটি বড় শহর ছিল--- মহেঞ্জদরো, হরপ্পা, রাখীগরহী, গণওয়াড়ীওয়ালা আর ধোলাভীরা। রাখীগারহী  হল ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় সাইট, বর্তমানে হরিয়ানার হিসারে। তারপরই গুজরাটের কচ্ছের রণের কাছেই কাদীর দ্বীপে এই ধোলাভীরা। বাকী তিনটি বড় শহরই বর্তমানে পাকিস্তানে। সমগ্র সাউথ এশিয়ার ধোলাভীরাতেই প্রথম গড়ে ওঠে নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা। সাতটি স্টেজে এখানে সভ্যতার উত্থান পতন পরিলক্ষিত হয়।

একদম প্রথমে যারা এখানে বসতি স্থাপন করেন তারা খুব ভাল পাথরের কাজ জানতেন, তামার কাজ, পাথর পালিশের কাজ জানতেন।নিজেদের বসতির চারপাশে পোড়া মাটির ইঁটের দূর্গ মত বানিয়ে নিয়েছিলেন। উত্তরে মানসর নদী আর দক্ষিণে মানহর  নদীর মাঝে ধোলাভীরাকে তখনও গ্রামই বলা চলে। 

দ্বিতীয় দফায় আস্তে আস্তে আরও জায়গা জুড়ে সভ্যতার বিস্তার ঘটতে থাকে,অ্যান্টিক দ্রব্য বানানো শুরু হয়, তার সাথে সেরামিকের কাজের আরও উন্নতি চলল। এরপর তৃতীয় দফায় সৃষ্টিশীলতা তখন চরম শিখরে পৌঁছেছে---গড়ে উঠেছে নগর সভ্যতা। বিশাল জলাধার বানানো হয়েছে সারা বছরের জলাভাব দূর করার জন্য, তবে নগরেরর চারপাশ ঘেরা আছে দূর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে।

চতুর্থ পর্যায় পাওয়া যায় হরপ্পান সভ্যতার প্রচুর নিদর্শন, উন্নত পয়ঃপ্রণালী, বৃষ্টির জল ধরে রাখা বিশাল জলাশয়। এখানেই প্রচুর ফ্যাক্টরীর মত জায়গা পাওয়া যায় যেখানে ফ্রী স্ট্যান্ডিং পিলার তৈরী হত। লাইমস্টোন দিয়ে বানান হত পিলারগুলো, প্রচুর মর্টার পাওয়া গেছে। উত্তরের গেটের মুখে পাওয়া গেছে দশ শব্দের হরপ্পান ভাষায় লেখা শিলালিপি, যার আজও পাঠোদ্ধার হয়নি। সমাজে তখনও ছিল শ্রেণী বিভাজন, উচ্চবিত্তরা উঁচু জমিতে তৈরী দূর্গে থাকতেন, আলাদা জলের ব্যবস্থা।

পদার্থবিদ্যা আর অ্যাস্ট্রোনমি ছিল বড়ই উন্নত।প্রচুর পাথরের নানান সাইজের ওজন মাপার বাটখারার মত জিনিস পাওয়া গেছে। দূর্গের  উত্তর দক্ষিন প্রাচীরের দুরত্ব আর পূর্ব পশ্চিম প্রাচীরের দুরত্বের অনুপাত ৫/৪। প্রাচীরের ইঁট অদ্ভুত ইন্টারলক সিস্টেমে বানানো, যাতে বন্যার জলের চাপ প্রতিরোধ করতে পারে। আবার স্নানাগারে রাখা জল যাতে ঠান্ডা থাকে তাই তার দেওয়ালে নীচের দিকে আছে পুরু মাডস্টোন।নালীর মুখে গোল ভারী পাথরের চাকতি দিয়ে ঢাকা। দূর্গের প্রবেশ দ্বার উত্তর দিকে আর পূর্ব মুখে। দক্ষিণে জলের জায়গা, ধাপে ধাপে জল পরিশুদ্ধিকরণের ব্যবস্থা চলেছে, ঠিক যেন এযুগের আধুনিক সিস্টেম। পশ্চিমে রয়েছে কবরখানা। উত্তরের দরজা দিয়ে বেরিয়েই ছিল চওড়া রাস্তা, একদিকে বাজার অন্যদিকে স্টেডিয়াম। এরপর মধ্যবিত্তদের বসতি আর তার নীচের জমিতে কারিগর, শ্রমিক নিম্নবিত্তদের ঘরবাড়ী। পাশের মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলাম অনেক ধরণের পাথর ঘষার ব্লেডও পাওয়া গেছে। নানান অস্ত্র শস্ত্রও তৈরী হত,  কাঠের দরজা বন্ধ করার শঙ্কু আকৃতির ডোর স্টপারও পাওয়া গেছে। কচ্ছের গরুর গাড়ী আর হরপ্পার গরুর গাড়ী দেখতে হুবহু এক রকমের। লাপিজ লাজুলি, টারকোয়েজ, অ্যাগে্ট, জেসপার নানান ধরনের পাথর এখানে পাওয়া যেত। মিউজিয়ামে এক জায়গায় লেখা ছিল মরদক বেট যা বর্তমানের লিটল রান, খানদিক যা হল বর্তমানের কচ্ছ উপত্যকা আর দক্ষিণ গুজরাটের রতনপুরা সেসময় থেকে আজকের যুগেও নানাধরনের পাথরের ভান্ডার।এছাড়া মিউজিয়ামে রাখা ছিল নানান শেপের মৃৎপাত্র, কড়ি যা নিয়ে খেলাধুলো চলত।

পঞ্চম পর্যায়ে কেমন যেন চারদিকে অবহেলার ছাপ, যদিও মাটির তৈরী পাত্র, মুদ্রা সবই আরও উন্নত, কিন্তু শহর যেন ভাঙ্গাচোরা, এরপর বেশ কিছুকাল যেন পরিত্যক্ত। অনুমান লাগাতার ভুমিকম্পই দায়ী।

ষষ্ঠ পর্যায়ে আবার দেখা যাচ্ছে বসতি গড়ে উঠেছে, হরপ্পার পরবর্তী যুগের সব চিহ্নই ছড়ানো চারপাশে। কিন্তু বাড়ীর গড়ন অন্যরকম--গুজরাটের অন্য গ্রামের মতই সেগুলো। সপ্তম পর্যায়েও একই দশা, এককালের সেই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছনো সেই নগর সভ্যতা কোথায় যেন বিলুপ্ত হয়ে গেল। 

বর্তমান মানচিত্রেও দেখা যায় গুজরাটের আরব সাগর পেরিয়ে,পাকিস্তান তো আজও অনায়াসেই পৌঁছানো যায়। ইরাক, ইজিপ্ট সবই আজও জলপথে যুক্ত। গুজরাটের কচ্ছ উপত্যকার ভুজ শহর আজও ভীষনই ভুমিকম্প প্রবণ। আরও আশ্চর্য লাগল দেখে ভুজ শহরে এক অতি প্রাচীন সরস্বতী মন্দির দেখে। সরস্বতী নদী আজ হয়ত লুপ্ত তবু সরস্বতী মন্দির দেখে মনে হল হয়ত তাকে স্মরণ করেই দেবীকে পুজো করে চলেছে স্থানীয় মানুষরা। 

যাওয়ার রুটঃ লোথাল আমেদাবাদ থেকে ৯০ কিমি। প্রাইভেট গাড়ী নিয়ে যাওয়া যায়।

ধোলাভীরা ভুজ থেকে গাড়ী পথে ২৩০ কিমি। ঘন্টা পাঁচেক লাগে পৌঁছতে।

(ছবি সৌজন্যে:স্বয়ং প্রতিবেদক) 

(www.theoffnews.com - Gujarat Harappan)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours