তানজিন তিপিয়া, লেখক ও রন্ধন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ:

ইংল্যান্ডে সূত্রপাত কিন্তু ছড়িয়ে পড়ছে দেশ দেশান্তরে। বিগত পুরো একটি বছর কেটে গেলো এই ভাইরাসে। আবারো নতুন রূপে প্রকট তিনি। অনেক দ্রুত ছড়ায় কিন্তু প্রাণঘাতী কি না তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। যত দূর জানা যায়, ছড়ায় দিগুণ গতিতে কিন্তু প্রাণ যাবে কম সাথে বর্তমান টিকাটিও এই ভাইরাসে হবে শতভাগ কার্যকর। কারণ, ফাইজার, মডার্না এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকাগুলোর সবগুলোতেই করোনাভাইরাসের স্পাইকটিকে আক্রমণ করার জন্য মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে 'শিখিয়ে দেওয়া' হচ্ছে।

ভাইরাস সব সময়ই নিজেকে পরিবর্তন করে নতুন রূপ নেয় এটি খুব স্বাভাবিক -একে বলে ভাইরাস মিউটেশন। মূলত “ডিএনএ” ধ্বংস বা পরিবর্তন অথবা দেখতে একই কিন্তু বাস্তবে এক নয় এমন আরেকটি “ডিএনএ” তৈরি। এটি সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি, ধুপ পান থেকেও ঘটে থাকে। 

সহজ ভাষায় কোষ বিভাজিত হয়ে নকল, অকেজো ডিএনএ নিরবচ্ছিন্নভাবে তৈরি হতে থাকা। আরেকটু বুঝিয়ে বলি- পিতামাতা হতে সন্তান, সন্তান হতে নতুন প্রজন্ম। সন্তান খুব ভালো শান্ত, অনেক সময় খুব রাগালো খিটখিটে, আবার অনেক ক্ষেত্রে মিশ্র প্রকৃতির ভালো খারাপ সবমিলিয়ে নিজের মতো, ঠিক এমনটাই।

ভাইরাসের এই রূপ পরিবর্তনের লক্ষ্য হলো- মানব দেহে প্রবেশ করে বহু সময় ধরে টিকে থেকে বংশবৃদ্ধি। 

ভাইরাসের মিউটেশনের খবর দেখে উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক সময় এ পরিবর্তন হয় প্রায় অর্থহীন, কখনো এটি মানুষকে সংক্রমণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

আবার কখনো কখনো এটি আরো বেশিদিন টিকে থাকার এবং সংক্রমণ বাড়ানোর 'উইনিং ফরমুলা' পেয়ে যেতে পারে।

কোভিড-১৯ জেনোমিক্স ইউকে নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক নিক লোম্যান বলছেন, "করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর রকমের বেশি সংখ্যায় মিউটেশন হয়েছে। তবে এর মধ্যে কয়েকটা মিউটেশন আমাদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।"

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মিউটেশনটা হয়েছে মূলত: দুই ধরণের।

করোনা ভাইরাসের গায়ে কাঁটার মতো কিছু 'স্পাইক' থাকে এবং তাতে থাকে বিশেষ এক ধরণের প্রোটিন। মানবদেহের কোষের বাধা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য এই প্রোটিনকে ব্যবহার করে করোনা ভাইরাস, এবং তাকে 'দখল করে' নেয়।

স্পাইকগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে "রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন"। এই অংশটিকেই পাল্টে দেয় 'এন ফাইভ জিরো ওয়ান' নামের মিউটেশনটি।

কাঁটার মতো অংশ দিয়েই করোনা ভাইরাস প্রথমে মানবদেহের কোষগুলোর সংস্পর্শে আসে। এখানে যদি এমন কোন পরিবর্তন হয় যাতে ভাইরাসটির দেহকোষের ভেতরে প্রবেশ সহজ হয়ে যায় - তাহলে বলতেই হবে, এটা এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।

অধ্যাপক লোম্যান বলছেন, দেখেশুনে এটাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বলেই মনে হচ্ছে।

করোনা ভাইরাসের অন্য আরেকটি মিউটেশনের নাম 'এইচ সিক্স নাইন/ভি সেভেন জিরো'। এটি সন্ধান আগেই বেশ কয়েকবার পাওয়া গেছে।

বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কে মিংক নামে এক ধরণের প্রাণীর খামারেও (এর লোম, চামড়া দিয়ে পোশাক তৈরি হয়) মিউটেশনটি পাওয়া গিয়েছিল।

উদ্বেগের বিষয় হলো- সংক্রমণের পর বেঁচে যাওয়া মিংকের রক্তে যে এ্যান্টিবডি পাওয়া যায় - তা ঐ মিউটেশনটিকে আক্রমণের ক্ষেত্রে কম কার্যকরী।

বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ্যালান ম্যাকনালি বলছেন, "আমরা জানি যে করোনা ভাইরাসের একটা ভিন্ন স্ট্রেইন আছে, কিন্তু জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকে এটার মানে কি - তা আমরা এখনো জানি না।"

"এটা গুরুত্বপূর্ণ কিনা বা কতটা - সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত টানার সময়ও এখনো আসেনি।"

এই বিশেষ ভাইরাসটি এমন একটি ভাইরাস যা প্রাণীর দেহে বিবর্তিত হয়েছে এবং মানবদেহে সংক্রমণ করতে শুরু করেছে মাত্র বছর খানেক আগে।

তারপর থেকে এটিতে প্রতি দু'মাসে একটি করে মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটছে।

আমরা যদি আজ করোনা ভাইরাসের একটি নমুনা নিই, এবং এর সাথে চীনের উহানে প্রথম দিকে পাওয়া ভাইরাসের সাথে তুলনা করি - তাহলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে প্রায় ২৫ দফা পরিবর্তন হয়েছে।

এর আগে জি সিক্স ওয়ান ফোর নামে করোনা ভাইরাসের আরেকটি প্রকার সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে "ভাইরাসটি এখন নিজেকে সহজে ছড়ানোর উপযুক্ত করে নিচ্ছে।"

তবে কিছুদিন পরই যখন গণহারে মানুষকে টিকা দেয়া শুরু হবে - তখন করোনা ভাইরাসের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হবে। তাকে তখন টিকা নেওয়া মানুষকে সংক্রমণের জন্য নিজেকে আবার পরিবর্তন করতে হবে।

এখন, সত্যিই যদি টিকার কারণে ভাইরাসের নতুন বিবর্তন ঘটে যায় - তাহলে আমাদের সেই টিকাকেও - কার্যকরী থাকার স্বার্থে – নিয়মিত তাতে পরিবর্তন আনতে হবে।

প্রায় সব দেশ যুক্তরাজ্যের সাথে ফ্লাইট বাতিল করেছে। কিন্তু এভাবে আর কতো বছর? আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে দেখতে বারো মাসের বেশি সময় পার করে দিয়েছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সামাজিক দূরত্ব বজিয়ে রেখে, মাস্ক পরে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থেকে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে। ঠিক আছে সাথে এটিও মানলাম যে বেশির ভাগ দেশে করোনা বিধিগুলো যথাযথ পালিত হয়নি কিন্তু যেখানে পালিত হয়েছে ওখানেও তো পরিনতি খুব একটা ভিন্ন নয়। 

যদিওবা বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদদের মতে- বর্তমানে করোনা ভাইরাসকে লোকেরা আর আগের মতো ভয় পাচ্ছেন না। ভয় কমে গেলে তো ভ্যাকসিন ব্যবসায় দেখা দিতে পারে মন্দা। তাই হয়তো বড় উদ্যোগপতিরাই লোকেদের মাঝে উদ্বেগ টিকিয়ে রাখতে এমন খবর ছড়িয়েই চলেছেন। সেই সাথে উঠতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে নাজুক করে দেবারও এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। এতে পৃথিবীর পরাশক্তি দেশগুলো পরম শক্তি নিয়ে টিকে থাকবে আর মাথা তোলা দেশগুলো উন্নয়নের সিঁড়ি চড়ার আশাতেই গুটিয়ে পড়বে।

তাহলে কি সকল স্বাস্থ্যবিধি কাল থেকে বাদ? অবশ্যই নয়। করোনা আমাদের কিন্তু খুব সুন্দর কিছু বিধি বিধান শিখিয়েছেন সাথে চরম মাত্রায় বাড়িয়েছেন স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস যা শুধু করোনা থেকেই সুরক্ষিত রাখতে নয়, অন্যান্য সকল প্রকার রোগ ব্যাধি হতে দেহ এবং মনকে মুক্ত রাখতে ভ্যাকসিনের মতোই কাজ করছে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠতেও ভূমিকার কমতি নেই। তাই নিয়ন কানুনগুলো মেনে চলতে কোন কিপটেমি, আলসেমি, ন্যাকামি একদমই নয়।

(ছবি সৌজন্যে: প্রতিবেদক স্বয়ং) 

(www.theoffnews.com - Bangladesh corona virus vaccine new stain)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours