পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

এমনই একটা শীতকালের রাত। বাবা মায়ের সঙ্গে উত্তর ২৪ পরগণার অশোক নগরে একটি গানের জলসায় গিয়েছে ছোট্ট একটি শিশু। কতই বা বয়স, চার কিম্বা পাঁচ। দুষ্টু, চঞ্চল সেই শিশু একজায়গায় চুপ করে বসে গান শুনতে মোটেই সম্মত ছিল না। বাবা মাও তাকে নিয়ে বিব্রত, বিপর্যস্ত। এমন সময় মঞ্চে উঠলেন নতুন শিল্পী, বলি ও ননদি, আর দু মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে... ব্যস কাজ হল ম্যাজিকের মত। হাততালি দিয়ে বসে গেল সেই শিশুটি, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মগ্ন শ্রোতা। সেদিনের সেই শিশুটি আজকের আমি। সেই বয়সে স্বপ্না চক্রবর্তীকে চেনা বা জানার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ওই গান তখন মুখে মুখে ফেরে, শিশু বয়সে তা আমার কানেও তৈরি করেছিল সুখের আবেশ। প্রায় ২০ বছর পরে এই গল্পই যখন স্বপ্নাদিকে বলছিলাম, হেসে উঠেছিলেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। বীরভূমের সিউড়ীতে বাস স্বপ্নাদির। সাংবাদিকতার পেশায় বদলি হয়ে আমিও সিউড়ীতে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কারনে বাইট নিতে যেতাম স্বপ্নাদির কাছে। সময় থাকলে বসে একটু আড্ডাও হত কখনও কখনও। সেদিনের সেই গানগুলি কিন্তু আজও সুপারহিট। "বড় লোকের বিটি লো", "বলি ও ননদি" এখনও লোকের মুখে ফেরে। এমন হিট গান, এখনও এত চাহিদা, কিন্তু স্বপ্নাদিকে চেনেন ক’জন? এখনকার প্রজন্মও তার গান গায়, কিন্তু তার কথা জানে কি? আক্ষেপ কিন্তু ছিল স্বপ্নাদিরও, সম্মান বা জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, কিন্তু তা স্বত্বেও কোথাও যেন একটা ব্যথাও আছে। সরাসরি কিছু বলেননি, তবে আক্ষেপটা ধরা পড়ত। লোকগানের আরও প্রসার, আরও ব্যপ্তি চাইতেন। 

একই সুর আশানন্দনের গলাতেও। এই দেখুন, আশানন্দন চট্টরাজের নামই শোনেননি বোধ হয়। হেতমপুরের শিক্ষক, কবি, গবেষক আশানন্দন চট্টরাজ। কিন্তু তার আরও একটা জব্বর পরিচয় আছে বটে। "বলি ননদি" গানটা তারই লেখা। এবার বোধগম্য হল তো। একই ভাবে সিউড়ীর রতন কাহারের নামও কেউই মনে রাখেননি, ভাগ্যিস র‍্যাপ গায়ক বাদশা তার গানে এতদিন পরে হঠাৎ "বড় লোকের বিটি লো" গানের মুখড়াটা যোগ করে বিতর্ক তৈরি করেছেন। তাই তো সকলের জানা হল এই গানের রচয়িতা রতন কাহার। গান সকলের মুখে ফেরে, কিন্তু সেই গানের রচয়িতাকে আমরা জানার চেষ্টাই করি না। স্থানীয় ভাবে আশানন্দন বাবু সম্মান শ্রদ্ধা ভালবাসা নিশ্চয় পেয়েছেন। কিন্তু তার পরিচিতির গণ্ডিটা আরও একটু প্রসারিত হলে আমাদেরই কিন্তু লাভ হত। গ্রামে গঞ্জে মফঃস্বলে এভাবেই নানা সুপারহিট লোকসঙ্গীতের পিতা মাতারা ছড়িয়ে আছেন। 

২০০১ সাল। বিষ্ণুপুরে আমার সহকর্মী স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা চারন কবি বৈদ্যনাথের জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছি আমি। রাত হয়ে যাওয়ায় ফিরতে পারিনি, একটি ঘরে রাতে আমরা তিনজন। আমার সঙ্গে কবি অরুন চক্রবর্তী এবং সংবাদ কর্মী সাহিত্যিক সাত্যকী হালদার। আমি গোবরডাঙ্গার ছেলে, সাত্যকিদা আবার হাবড়ার মানুষ। সহজেই জমে উঠল আড্ডা। অরুণদাও বেশ দিলদরিয়া লোক। কবি হিসেবে অরুণদার হাল অবশ্যই আশানন্দন বাবুর চেয়ে ঢের ভাল, তবুও অনেকের সুবিধার জন্য বলি অতি বিখ্যাত লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা, রাঙ্গামাটির দ্যাশে যা... গানটি অরুণদার লেখা। সে রাতেই শুনেছিলাম শ্রীরামপুর স্টেশনে একটি মহুয়া গাছকে দেখে তার এই গানের কথা মাথায় আসে। কবির মুখ থেকে তার সৃষ্টির ইতিহাস শোনাটা একটা অভিজ্ঞতা বটে। কিন্তু এই হাসি মজার মাঝে সূক্ষ খোঁচাও ছিল অরুণদার কথায়, “ভাগ্যিস এই গানটা(পড়ুন কবিতাটা) লিখেছিলুম, না হলে তোমরা তো চিনতেই না আমাকে।” মুখের হাসি বজায় থাকলেও মনের হাসিটা থমকে গিয়েছিল; সত্যিই তো এই গান তো সকলেই জানে সকলে কি অরুণদাকে চেনে? উত্তর তো অরুণদার কথাতেই আছে।

একটা কাজে গিয়েছিলাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। ঠিক ধরেছেন বাংলার দাদা। না, গল্প তাঁকে নিয়ে নয়। পাশেই বাপের বাড়িতে ডোনা গাঙ্গোপাধ্যায় নাচের ক্লাস করান। সেখান থেকেই ভেসে এল একটা সুর – বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ চিংড়ি কচি লাউ । এই গানের তালে নাচছে কচিকাঁচা। শুনতে শুনতে মন চলে গেল চুরুলিয়ার পথে। না কাজী নজরুলের লেখা গান এটি নয়। চুরুলিয়ার স্কুল শিক্ষক গিয়াসুদ্দীন দালাল এই গানের জনক। তার নাম নিশ্চয় আপনারা শোনেননি। কিন্তু তার সৃষ্টির সঙ্গে কম বেশি সকলেই পরিচিত। লোপামুদ্রার এই গান এখন প্রায় সব স্কুলের ফাংশনে গাওয়াটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দুঃখের কথা গিয়াসউদ্দীন বাবু যখন অবেক্ষণে লেখা পাঠান (আমার অনুরোধে) তখন তার নামের পাশে লেখা থাকে বাংলা আমার সর্ষে ইলিশের রচয়িতা। এটাই তার একমাত্র পরিচয় কি?  

লোকগান নিয়ে চর্চা করতেন কালিকাদাও। কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য। শুধু গান গাওয়া নয়, গানের গবেষণার মাধ্যমে গভীরে বা মূলে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করবার জায়গা নেই একটি চ্যানেলে গানের রিয়্যালিটি শো-এ যোগ দেওয়ার আগে কালিকাদার পরিচিতি বা জনপ্রিয়তা ছিল নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মধ্যেই। কালিকাদা অবশ্য নিজে এটা নিয়ে সরাসরি কিছু বলতেন না, বরং আশাবাদী ছিলেন একদিন মানুষ লোকগান শুনবে। তার সেই ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েই হয়তো এখন লোকগানের প্রসার বেড়েছে। বিভিন্ন উৎসবে, অনুষ্ঠানে বা রিয়েলিটি শোয়ে এখন লোকগানের আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটা জিনিস দেখে ভাল লাগল, যারা লোকশিল্পী তারা বাদ দিয়েও চেনা অচেনা প্রায় সব শিল্পীই কিন্তু লোকগান গাইছেন। বর্তমান সরকারও লোকশিল্পীদের জন্য কিছু ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। তার ফল এই উৎসবগুলিতে লোকশিল্পীদের নিয়মিত অংশগ্রহণ, লোকগানের ব্যপ্তি। কিন্তু তার মাঝেও কাঁটার মত বেঁধে দূরে থাকা লোকগানের ওই উজ্জ্বল জ্যোতিস্কদের মুখগুলি ভেবে। যাদের কথা লিখলাম তাদের কেউ কেউ আজ আর নেই, কিন্তু যারা আছেন তাদের জন্য আরও একটু যত্নপরায়ণ কি আমরা হতে পারি না? 

আরও অনেক অনেক মানুষ আছেন এমনই কৃতি সম্মানীয়। আমি শুধু আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার কথা লিখলাম। আমি যাদের সংস্পর্শে এসেছি বা যাদেরকে চিনি শুধু তাদের কথা। এছাড়াও বাংলার আনাচে কানাচে আছেন এমন অনেক অমূল্য রতন তাদের প্রতিও রইল আমার শ্রদ্ধা মেশানো নমস্কার।

(www.theoffnews.com - Bengali folk song writers)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours