পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

২০০৬ সালের এক ভোর বেলা। ইটিভির অফিস কাম রেসিডেন্সের বাইরে একটা গণ্ডগোলের শব্দ শুনে বেরিয়ে দেখি ফুল চুরি নিয়ে বচসা হচ্ছে। এক প্রৌঢ়া না বলে ফুল তুলছিলেন বলে আমাদের বাড়ির মালিক তাকে দুকথা শোনাচ্ছেন। সেই প্রৌঢ়া অবশ্য বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে ফুল নিয়ে চলে যান। সামান্য ব্যাপার, মিটেও যায়। দুপুরে একটি খবরের ব্যাপারে জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। হঠাৎ আমার স্ত্রীর ফোন, বাড়ির বাইরে হাজার খানেক মানুষ। সকালের ফুল তোলার ঘটনার প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন তারা। কেন ফুল তুলতে বাধা দেওয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে মারধোরের মিথ্যা অভিযোগে চড়াও সকলে। তড়িঘড়ি পৌছে দেখি কিছু মহিলা বাড়ির মালিকের স্ত্রীকে মারতে উদ্যত, আমার স্ত্রী তাকে আড়াল করে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।  স্থানীয় সিপিএম নেতা শাসাচ্ছেন, “দেখি কে রক্ষা করে আজকে। কোনও ইটিভি জিটিভি বাঁচাতে পারবে না”। আমাকে আসতে দেখে অবশ্য একটু দমল সেই নেতা। সরাসরি ফোন করলাম বারাসতের পুরপ্রধানকে, পুলিশ সুপারকে। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে দেখে উন্মত্ত জনতা (পড়ুন সিপিএম কর্মীরা) খানিক থমকাল। সকলের হস্তক্ষেপে একটু পরে তারা গেল বটে, কিন্তু দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে গেল। পরের দিন পার্টি অফিসে মিটিং, জানানো হয়েছে ক্ষতিপুরণ দিতে হবে একলাখ টাকা। আমি সঙ্গে গিয়েছিলাম বলে বাড়ির মালিক দাদাকে খুব হেনস্থা হতে হয়নি। কিন্তু ভাবুন একবার আমরা পাশে না থাকলে কি হত? আমার সামনে ঘটা একটা ছোট্ট ঘটনা এমন রূপ নিতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। পরে জানলাম দিদিরা কংগ্রেস মনস্ক। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের একটু “টাইট” দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। এই সুযোগকেই কাজে লাগানো হয়েছে। একটা ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র উদাহরণ বাম আমলে খবরদারীর। নেতাই, নন্দীগ্রাম, আমতা, সাঁইবাড়ি, সিঙ্গুর এ সব বড় বড় ঘটনার কথা তো আপনাদের সকলেরই জানা।  

যারা একটু খোঁজ খবর রাখেন বা রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা নিশ্চয় মানবেন ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার বছর দুয়েক আগে থেকেই দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হচ্ছিল। বাম আমলে শেষ দিকের কয়েকটা বছর বাম তথা সিপিএম নেতা কর্মীদের অত্যাচার বা খবরদারি চরমে উঠেছিল। বাড়ির পরিচারককে নিয়ে সমস্যা হলেও তা মেটাতে যেতে হত স্থানীয় পার্টি অফিসে। পরতে পরতে চোখ রাঙানি, শাসানি, যে কোনও বিষয়ে পার্টির অনধিকার প্রবেশে তিতিবিরক্ত সাধারণ মানুষ। সর্বহারা বাম নেতাদের সম্পত্তি, বৈভব, চাল চলন দেখে চোখ কপালে উঠেছিল মানুষজনের। ২০১১ সালে সেই তিলে তিলে জমতে থাকা ক্ষোভ, বেদনা, বিরক্তি, রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখেছিল বাংলা। ধুয়ে মুছে গিয়েছিল বামেরা। বিপুল জনাদেশে তৃণমূলের আসার কথা সকলেই জানেন। কিন্তু রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের দাবি ছিল এই পরিবর্তনের পিছনে তৃণমূলের প্রতি ভালবাসা যা ছিল তার থেকে অনেক গুণ বেশি ছিল বাম, বিশেষ করে সিপিএমের প্রতি বিতৃষ্ণা। 

প্রায় একই পরিস্থিতি এখনও। নিজের দুকাঠা জমি বিক্রি করবেন? স্থানীয় তৃণমূল নেতা ছাড়া গতি নেই। করোনায় অবস্থা খারাপ, রাস্তার পাশে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা ছোট্ট গুমটি দোকান করবেন? তৃণমূল নেতার অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয়। সরকারি প্রকল্পের টাকা বা সুবিধা নেবেন? তৃণমূল নেতাকে প্রসাদ না দিলে মিলবে না। কোনও কিছুর প্রতিবাদ করবেন? বাড়িতে বৌএর জন্য সাদা থান পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি চলে আসবে। অর্থাৎ যে বিভীষিকা থেকে বাঁচতে মানুষ পরিবর্তন এনেছিলেন সেই বিভীষিকা আরও ভীষণ রূপে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার চেয়েও দ্রুতগতিতে, মারাত্মক ভাবে। স্বভাবতই ধাক্কা খাওয়া মানুষ বিকল্প খুঁজে চলেছেন। কিন্তু সামনে বিকল্প বলতে বিজেপি। 

কেন্দ্রে থেকে বিভিন্ন ভাবে এই বিজেপি সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে জনগনের জন্য তারা ভাবতে নারাজ। কাশ্মীরে ৩০৭ ধারা তুলে দেওয়া, পাকিস্তানে গিয়ে হামলা করে আসার দাবী করা, তিন তালাক প্রথা তুলে দেওয়া ইত্যাদি চমক দেখে কেউ কেউ ভুলেছেন বটে, কিন্তু এগুলিতে দেশের গরীব বা মধ্যবিত্তের কি লাভ হয়েছে? বরং দিনে দিনে আমরা গরীব থেকে আরও গরীব হয়ে পড়ছি। জ্বালানি বা ভোজ্য, যে কোনও তেলের দাম এখন  সর্বকালের সেরা দরে পৌঁছেছে। যার আঁচ পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কেন্দ্র এখন দিল্লিতে কৃষকদের সঙ্গে চোর পুলিশ খেলে অন্যদের নজর রাখছে সেই দিকে।

তাই বাংলার মানুষের সামনে থাকা বিকল্প এলে যে মোটেই ভাল কিছু হবে না, তা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছেন অধিকাংশই। তবুও আশায় বাঁচে চাষা।  বিজেপির সর্বগ্রাসী কেন্দ্রীয় নেতারা বাংলা দখলের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এবারে বিজেপির সামনে যে একটা সম্ভাবনা ছিল না, তা কিন্তু নয়। লোকসভা নির্বাচনে কিছুটা বোঝা গিয়েছে মানুষের মন। কিন্তু লোকসভার পরে বিজেপি নেতাদের অতি সক্রিয়তাই এই ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। উগ্র হিন্দুত্ববাদ ছাড়া বিজেপিকে আলাদা করে ভালবাসার কিছু নেই বাংলার মানুষের কাছে। কিন্তু মরিয়া হতে গিয়ে মরতে বসেছে বিজেপি। যে তৃণমূল নেতা বা কর্মীদের অত্যাচারে মানুষ এখন তিতিবিরক্ত সেই দল থেকেই বিভিন্ন দাগী নেতাদের দলে টানতে উৎসাহী বিজেপি। সেই নেতাদের অনেকেরই সেভাবে জনসমর্থন আছে কিনা তা তলিয়ে দেখছে না বিজেপি নেতৃত্ব। তারা শুধু নেতা ভাঙাতেই ব্যস্ত। এজন্য নিজেদের দলের বহুদিনের কর্মী বা নেতাদেরও রেয়াত করছে না বিজেপি। এটাই ভাল নজরে দেখছেন না বাংলার মানুষ। 

এর পরে আছে বিজেপি কর্মীদের আলটপকা নানা মন্তব্য। বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি নিয়ে এ রাজ্যের মানুষ স্বাভাবিক গর্বে আচ্ছন্ন। সেখানে হোম ওয়ার্ক না করেই বিভিন্ন নেতা নানা বেফাস মন্তব্য করে দলের বিপদ ডেকে আনছেন। সাম্প্রতিক জয় শ্রীরাম বিতর্ককেও বাংলার মানুষ খুব ভাল ভাবে নেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্তেজিত করে মজা দেখবার অভিপ্রায়ে জয় শ্রীরাম কাণ্ড ঘটালেও এটা ব্যুমেরাং হয়েছে বিজেপির কাছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন বাংলার মানুষ। কারন অনুষ্ঠানটি ছিল বাংলা তথা দেশের অন্যতম গর্ব নেতাজীকে নিয়ে। সেই অনুষ্ঠানে রাম কতটা প্রাসঙ্গিক এটা বিজেপির সাফাইতে মোটেই স্পষ্ট নয়। 

সব মিলিয়ে রাজনৈতিক মহলের ধারণা, বিজেপির দিকে কিছুটা ভোটের হাওয়া বইলেও এই সময় অতি সক্রিয়তাই বিপদ ডেকে আনতে পারে তাদের। বরং নেতা কর্মীদের বাক সংযত হতে বলে খানিকটা নিস্ক্রিয় থাকলেই জেতার কিঞ্চিৎ আশা রয়েছে। কিন্তু মুখ খুললেই বিপদ। কেন্দ্রের জনবিরোধী নানান নীতি এবং বাংলার বিজেপি কর্মীদের শিশুসুলভ কাণ্ডকারখানায় ওয়াকওভার পেয়ে যাচ্ছে বিপক্ষই। অতএব সাধু সাবধান। বহুদিন আগেই তো জ্ঞানী মানুষেরা বলে গিয়েছেন কথা কম বলাই ভাল। এটা বিজেপির বাংলার নেতারা না বুঝলে কেন্দ্রের বাংলা জয়ের স্বপ্ন কিন্তু অধরাই রয়ে যেতে পারে।

(www.theoffnews.com - Wear Bengal politics BJP TMC CPM)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours