ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

বাংলা নববর্ষের মতো ইংরেজি নববর্ষ পালন করার প্রচলন চালু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। আকাশ সংস্কৃতির দৌলতে বিশ্ব যেমন নিকটে চলে এসেছে। তেমনি বিশ্ব সংস্কৃতিও প্রতিস্থাপন হয়েছে। এখন আর মনেই হয় না এটা আমার সংস্কৃতি না, বা এটা আমার সংস্কৃতি। খাবার, পোশাক, চলনে বলনে সবই এখন এক হয়ে গেছে। পয়লা বৈশাখ যেমন বাঙালির ঘেরাটোপ থেকে সুদুর ইংরেজ মহলে পৌছে গেছে। তেমনি নিউ ইয়ারও বিশ্বব্যাপী পৌছে গেছে। যেহেতু ইংরেজি ভাষা আর্ন্তজাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃত, তাই বিশ্বব্যাপী ইংরেজি সাল এবং ইংরেজি তারিখ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এ কারনে ইংরেজি নববর্ষ বা নিউ ইয়ার নিয়ে সবার একটু বেশিই উৎসাহ। খুব বেশি দিন হয়নি বাংলাদেশে নিউ ইয়ার পালন করার রীতি চালু হয়েছে। 

ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ রাত ১২টায় বিদায় জানানো হয় পুরানো বছর এবং ১২.১ মিনিটে বরণ করা হয় নতুন বছর। এভাবেই হ্যাপি নিউ ইয়ার পালন করার রীতি চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই নিউ ইয়ার পালন করার সংস্কৃতি চালু রয়েছে। পৃথিবীতে বসবাসকারী বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতি গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব রঙে ও ঢঙে নববর্ষ বা নিউ ইয়ার পালনের রীতি। এই সেলিব্রেশনের পিছনেই রয়েছে নানা ইতিহাস। ঠিক কবে থেকে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন শুরু হয়েছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছেই নেই। মনে করা হয় খ্রীস্টপূর্ব ২০০০ থেকে এই বর্ষবরনের রীতি শুরু হয়। তবে সবক্ষেত্রেই ১ জানুয়ারিতেই নিউ ইয়ার পালন হয় না। ব্যাবিলনে প্রাচীন আমলে নববর্ষ পালনের রীতির কথা শোনা যায়। কিন্তু তখন ক্যালেন্ডার ছিল না। সেই সময় বসন্ত বিষুবের সময় প্রথম পূর্নিমাই ছিল নববর্ষ পালনের সময়। প্রায় চার হাজার বছর যাবৎ এই দিনটিকে নববর্ষ হিসাবে পালন করে আসছে। নিউ ইয়ার উদযাপনের শুরু হয় গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের শেষ দিন ৩১শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। এই সময়টাকে বিশ্বব্যাপী নিউ ইয়ারস ইভ নামে পরিচিত। ৩১শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় চালু হওয়া এই উৎসব চলতে থাকে পরের দিন অর্থাৎ ১লা জানুয়ারী সারাদিন ব্যাপী। 

ইতিহাস খুঁজে জানা যায় নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন প্রথম পালন করা হয় খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ব্যাবিলনে। এই উৎসব পালন করা হতো মার্চের শেষভাগে যখন বিষুব অঞ্চলে দিন ও রাত সমান দৈর্ঘ্যে উপনিত হতো। আকিতু নামে জাকজমকপূর্ন এক ধর্মীয় উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি স্মরণীয় করে রাখতো। আকিতু উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছিল সূর্য দেবতা মারডুককে। তবে ব্যাবিলনীয়দের পৌরানিক কাহিনী অনুযায়ী, আকাশের দেবতা মাদদুক এক ভীষন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সমুদ্রের পিশাচীনি তিয়ামাতকে পরাজিত করেন। আকিতু মুলত সেই বিজয় উৎসবের নাম। আর এই দিনটিকেই তারা নববর্ষ হিসাবে পালন করতো। এই উৎসব ১১ দিন ব্যাপী পালন করা হতো। তখন তারা ঈশ্বরের কাছে শপথ নিতেন যাতে সারা বছর প্রতিটি কাজ ভালভাবে পালন করতে পারেন। এই উৎসবকে ঘিরে দেশের রাজাকে পুরাতন মুকুট ফেলে নতুন মুকুটে অভিষিক্ত করা হতো। তারা প্রতীকি ভাবে পুরাতন রাজ দন্ডকে নবায়ন করতো। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে বিভিন্ন সভ্যতার বিভিন্নভাবে দিনপঞ্জী প্রণয়নের নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীণ মিশরে বছরের সর্বশেষ নীল নদের বান ডাকার পর লুব্ধক নক্ষত্রের উদয়কালে নববর্ষের আয়োজন করা হতো। চৈনিকরা শীতকাল শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় পূর্ন চন্দ্রের দিনে নববর্ষ পালন করত। রোমান ক্যালেন্ডারের প্রতিষ্ঠাতা রোমিউলাস সূর্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ন করতে ৩০৪ দিন অর্থাৎ ১০ মাস নিয়ে একটি ক্যালেন্ডার আবিষ্কার করেন। এতে প্রতিটি বছর শুরু হতো বসন্ত বিষুবের দিনে। খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম শতকে অপর এক রোমান রাজা পম্পিলিয়াস প্রতিটি মাসের নামকরন করেন জানুয়ারিআস ও ফেব্রুয়ারিআস অর্থাৎ বর্তমানে যা জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী নামে পরিচিত। পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে বছর সম্পন্ন হয় ৩৬৫ দিনে। কিন্তু রোমান ক্যালেন্ডারে তখন এক বছরে ছিল ৩০৪ দিন। এতে সুর্যের বার্ষিক গতির সঙ্গে তাল মেলাতে সমস্যা হতো। পরবর্তীতে প্রখ্যাত রোমান সম্রাট জুলিয়াস ৪৬ খ্রীস্টাব্দে তৎকালীনি রোমের সকল পন্ডিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গনিতবিদদের সহায়তা নিয়ে আবিস্কার করেন গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার। জুলিয়াস সিজার বছরের প্রথম দিন হিসাবে ১লা জানুয়ারীকে বেছে নিয়েছিলেন। দেবতা জানুস এর নামানুসারে এই নতুন বছরের প্রথম মাসের নামকরন করা হয় জানুয়ারী। মধ্যযুগের ইউরোপে খ্রীস্টন নেতারা কিছুদিনের জন্য যীশু খ্রীস্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে পালন করতেন। পরবর্তীতে ১৫৮২ খ্রীস্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগোরি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ নববর্ষেও প্রথম দিন হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।

ইংরেজরা প্রতিবছর নববর্ষ বা নিউ ইয়ারে কেক কেটে, মোমবাতি প্রজ্জলন করে, আতশবাজির মাধ্যমে নিজেদের ভুল সংশোধন করে নতুন করে শপথ নেয়। যাতে তারা নতুন বছরে খারাপ কাজ পরিহার করে, ভাল কাজ করতে পারে। অথচ আমরা বাঙালিরা শুধু নববর্ষে বা নিউ ইয়ারে তাদের আনন্দটাই গ্রহন করেছি। শপথ নেওয়ার রীতিটা গ্রহন করতে পারিনি।

(www.theoffnews.com - Bangladesh Happy new year)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours