দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

কল্পতরু। ‘কল্প’ অর্থে কল্পনা এবং ‘তরু’ অর্থ, বৃক্ষ; অর্থাৎ এমন এক বৃক্ষ যা কল্পনার। পুরাণের পৃষ্ঠা ধীর গতিতে ওল্টালে এর সন্ধান পাই আমরা। সমুদ্রমন্থনে উত্থান, ইন্দ্রলোকের শোভাবৃদ্ধি ইত্যাদি কাহিনী আমাদের কাছে অজ্ঞাত নয়। পুরাণ অনুযায়ী এর বিশেষত্ব, এই বৃক্ষের নিকট মানুষের সর্বপ্রকারের কামনা পূর্ণ হয়। কিন্তু ‘কল্পতরু’ শব্দেই আছে ‘কল্পনা’। প্রশ্ন জাগে, যা কল্পনার তার বাস্তব অস্তিত্ত্ব তো অসম্ভব। তাহলে এই ‘কল্পতরু দিবস’-এর তাৎপর্য কি?

চলুন, ইতিহাসের সরণী ধরে এগোনো যাক। পতিতোদ্ধারিনী মা গঙ্গার পুণ্য তীরে লোকমাতা রাণী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরে অবস্থান করছেন যুগাবতার শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। যে সময়ের দিকে এই লেখনী অঙ্গুলি নির্দেশ করছে, তখন ঠাকুরের শরীরে দুরারোগ্য কর্কট রোগ তার করাল থাবা বসিয়েছে। বিভিন্ন ডাক্তারের আনাগোনা বেড়েছে দক্ষিণেশ্বরে। গলায় বড়ো ব্যাথা। খেতে কষ্ট হয়। কথা বলতে কষ্ট হয়। তাও প্রেমের জোয়ারে, ভক্তসঙ্গে লীলাময় প্রেমের ঠাকুর। এই সময়ই একদিন রহস্য করে বললেন, "যাওয়ার আগে প্রেমের হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাবো"।

শ্রী শরীর ভাঙছে ক্রমাগত। বড় ডাক্তার বললেন, বায়ু পরিবর্তন আবশ্যক। লীলার পটভূমি স্থানান্তরিত হল দক্ষিণেশ্বর থেকে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে। এখানে তাঁর বসবাসের সময়সীমা ১৮৮৫-র ১১ই ডিসেম্বর থেকে ১৮৮৬-র ১৫ই অগস্ট পর্যন্ত। দোতলার এক প্রশস্ত ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হল।

১৮৮৬-র ১লা জানুয়ারি। 

বিকেলবেলায় বেশ কিছু গৃহীভক্ত নীচের বাগানে কথাবার্তা বলছিলেন। এমন সময় ঠাকুর সেখানে এলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষও । ঠাকুর এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে “হ্যাঁ গো, তুমি যে আমার সম্পর্কে এত কিছু বলে বেড়াও, আমাকে তুমি কী  বুঝেছো?”, বিহ্বল গিরিশ নতজানু হয়ে বসে পড়লেন, “স্বয়ং ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর কী বলব?’’ কথাগুলি শ্রবণমাত্র ঠাকুরের ভাবসমাধি হল। তাঁর শ্রীমুখ থেকে নির্গত হল, “তোমাদের আর কি বলব, তোমাদের চৈতন্য হোক”। ব্যাস্, প্রেমের হাটে হাঁড়ি গেলো ভেঙে।  মুহুর্তে কাশীপুর উদ্যানবাটির বাগান যেন দিব্যক্ষেত্রে পূর্ণ হল। উপস্থিত সকল ভক্তরা হঠাৎ দৌড়ে এসে চীৎকার করে বলতে লাগলেন, “ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, দৌড়ে আয়। ঠাকুর আজ কল্পতরু হয়েছেন”। সে দৃশ্য কল্পনায় শরীর যেন শিহরিত হয়। সকলে ঠাকুরকে ঘিরে আত্মহারা, কেউ অঝোরে কাঁদছেন, কেউ করজোরে প্রার্থনা করছেন, আর ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু ঠাকুর প্রত্যেককে স্পর্শ করে উচ্চারণ করছেন মহাশীর্বাণী। তাঁর অন্তরের সমস্ত দিব্যপ্রেমভাব করুণাগঙ্গা হয়ে প্লাবিত করছে সকল হৃদয় ‘এস ছুটে এস, কে আছ মানব, ক্ষুদ্রকণ্ঠ পিপাসায়’।

কিন্তু ঠাকুর চৈতন্যের আশীর্বাদ কেন করলেন?

আবার ফিরতে হবে পুরাণে। পথশ্রমে ক্লান্ত এক ব্যক্তি একটি গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালেন। গাছটি যে কল্পতরু তা তিনি জানতেন না। হঠাৎ তিনি ভাবলেন, ‘‘খুব তেষ্টা পেয়েছে, একটু যদি জল পেতাম তো খুব ভাল হত।’’ ও বাবা, ভাবনা শেষ হতে না হতেই নানা রকম জল এসে হাজির। এ বার তার মনে হল, ‘‘একটু খাবার পেলে বেশ ভাল হত।’’ অমনি সুস্বাদু সব খাবার উপস্থিত। বিশ্রামের কথা ভাবতেই অমনি প্রস্তুত সুরম্য বিশ্রামাগার। এ বার তিনি ভাবলেন, ‘‘যদি কেউ একটু পা টিপে দিত, ঘুমটি বেশ ভাল হত।’’ এক সুন্দরী মহিলা অমনি উপস্থিত। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ‘‘এত সুখ আমার কপালে সইবে তো? হঠাৎ যদি বাঘ এসে হাজির হয়!’’ ভাবা মাত্র বাঘ এসে হাজির হয়ে লোকটিকে খেয়ে ফেলল।

গল্পের রূপকের আড়ালে রয়েছে এক মহান শিক্ষা। কল্পতরু বৃক্ষ বাস্তব হলে কি চাইতাম? মানুষের পার্থিব আকাঙ্খা বিরামহীন সমুদ্রের ঢেউ, যা কোনওদিনই আমাদের পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম হয় না। তাই কামনা করতে হবে সত্যের, সেই আমি-রূপী ব্রহ্মের যার খোঁজ চিরকালীন, যা অনন্তস্পর্শী।  

ঠাকুরের পুণ্যদেহ পঞ্চভূতে লীন হয়ে যাওয়ার পর বহুকাল অতিক্রান্ত। পুণ্যতোয়া গঙ্গা একই বিভঙ্গে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে চলেছে। কিন্তু তার দুই তীরবর্তী সময় আজ পরিবর্তিত। টেকনোলজি, গ্লোবালাইজেশন – শব্দগুলির পোশাকে মোড়া এই সময়। তবুও উন্নত মনুষ্যকূল যেন ঠিক সুখী নয়। সব থেকেও যেন এক অসীম অভাবমুখী যাত্রা আমাদের। বহিরঙ্গের প্রাচুর্য অন্তরের ক্লিণ্ণতাকে ঢাকতে সক্ষম নয়। তাহলে উপায়? অন্তরের চোখ মেলতে হবে। তবেই অন্তরে সহস্রদল শ্বেতপদ্মে সদাবিরাজমান অন্তরের ঠাকুরের কাছে আমরা পৌঁছতে পারব। আমরা দেখতে পাব, দুরারগ্য কালব্যাধির এতটুকু চিহ্ন নেই তাঁর মুখে। ‘নিরঞ্জন আনন্দমূরতি’। ত্রিতাপজর্জর আমাদের হৃদয় আপনিই নতজানু হবে। আমরা আবিষ্কার করব, তাঁর সন্মুখে নতজানু আমরা প্রত্যেকে এক। প্রত্যেকে সমান। অশ্রুসজল বিগলিত নয়নে আমরা দেখব, ভগবান শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আমাদের মাথায় হাত রেখে উচ্চারণ করছেন – 

“তোমাদের চৈতন্য হউক”।

(www.theoffnews.com - Shree Shree Ramkrishna)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours