শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

আমরা কি নিজেরা নিজের নাম রেখেছি? না,  রাখিনি। আমরা কি নিজেরা নিজেদের ভাষা নির্বাচন করেছি? তাও করিনি। আমাদের শরীরের রং কি হবে তা কি আমরা নিজেরাই নির্ধারন করেছি? তা তো অসম্ভব। আমরা কি আমাদের উচ্চতা কি হবে, তা আমরাই কি নিশ্চিত করেছি? আমাদের মাতৃভাষা কি হবে,  তা কি আমরা আগে থেকেই জানতাম? সোজা উত্তর, না, জানতাম না। অথবা আমাদের মা-বাবা কারা হবেন তা কি আমরাই পছন্দ করে রেখেছিলাম? রাখিনি। আমাদের দেশ কোনটা হবে অথবা ধর্মটাই বা কি হবে তাও কি আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি? না, তা নিইনি। আমাদের ভাষা, দেশ, চেহারা, শরীরের রং, উচ্চতা কি হবে, আমাদের পিতামাতাই বা কারা হবেন তার কোনটাই আমাদের কারোর সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল ছিলো না। সবই প্রাকৃতিক বিষয় ও পার্থিব প্রাসঙ্গিকতা। এমনকি আমাদের নামটা কি হবে, তাও মা-বাবা অথবা আত্মীয় ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে থাকে। অথচ আমরা, দেশ ও ধর্মের নামে কত না সংঘাতে লিপ্ত আছি! যত যুদ্ধ ও সংঘর্ষ তার অধিকাংশই হয়েছে জাতি ও ধর্মের নামে। যদিও আমরা কেউই মাতৃগর্ভে জন্মের আগে বা ভূমিষ্ঠ হয়েই জানতাম না, আমাদের জাতি ও ধর্ম পরিচয় কি হবে। আমাদের জাতি, ধর্ম পরিচয়, শরীরের রং ও উচ্চতা নিয়ে স্থানকাল পাত্র ভেদে কত না গর্ব অথবা হীনমন্যতায় ভুগে চলছি।

এ কথাগুলো আমরা সবাই জানি। তাই না? এসব কঠিন কথাও নয়, এখানে অঙ্ক, দর্শন ও বিজ্ঞানের জটিলতাও নেই। কথাগুলো একজন  নাবালকও জানে। কিন্তু এসব নিয়ে ভেবে দেখেছি কজন? আমরা ভেবে দেখেছি কি আমরা জন্মসূত্রে যে দেশ ধর্ম ভাষা পেয়েছি তার সবগুলোই প্রাকৃতিক! কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করছি কেন? কারন আমার কামনা মানুষ এসব নিয়ে ভাবুন। চিন্তক ও ভাবুক সকলে হয় না। হয় কেউ কেউ। চিন্তক হতে গেলে অন্বেষণ করতে হয়। ভাবুক হতে গেলে বিষয়ের গভীরে যেতে হয়। তা বিষয় যত সহজ ও সরল হোক না কেন।লোভী, ধূর্ত, শঠেরা চিন্তক ও ভাবুক হতে পারে না। তাদের সে সুযোগ নেই। নিরপেক্ষ ও সৎ না হলে ভাবুক ও চিন্তক হওয়া অসম্ভব। 

আমরা আমাদের সন্তানকে পাইলট, ডাক্তার   ইঞ্জিনিয়ার কত কিছু বানাতে চাই। চিন্তক বানাতে চাই না। কেন চিন্তক বানাতে চাই না? কারনটা পরিস্কার চিন্তকের জীবন অনিশ্চিত।  কোনও মা বাবাই চাইবে না তার সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হোক। একজন সৈনিকের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা না থাকলেও অন্তত তার জীবিকা নিশ্চিত থাকে। চিন্তকের জীবন ও জীবিকা দুটোই অনিশ্চিত। সৈনিকের পক্ষে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থাকে। চিন্তকের পক্ষে কেউ থাকে না। কেন? কারন চিন্তকেরা যে সব চিন্তা করেন, তাতে সমাজ রাষ্ট্র বিশ্বাস প্রথা ভেঙে পরার উপক্রম হয়। আর বহুল প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপন্ন দেখতে চাইবে! কেউ চাইবে না। তাই সহজে কেউ মুক্তি ও বিপ্লবের কথা বলে না। চিন্তকেরা মুক্তি ও বিপ্লবের কথা বলে। ভাবুকেরা প্রথা ভেঙ্গে ফেলার যম! প্রথা না টিকলে পুরাতন টিকে থাকতে পারে না৷ মানুষের পুরাতন ও নোংরা পোশাক পরিবর্তনের মত প্রথারও পরিবর্তন আবশ্যক। চিন্তা কখনো আলোকিত হতে পারে, আবার অন্ধকারও। আলোকিত চিন্তা সমাজে আলোর মশাল জ্বালায়। চিন্তা অন্ধকারের হলে পরিবেশের অন্ধকার হওয়া একেবারে নিশ্চিত। অন্ধকারে ধীরে হলেও সামনে পথ চলা যায়, পথ এগোয়। কিন্তু চিন্তার অন্ধকার খুব বিপদজনক সামনে পথ চলা যায় না৷ কেবল পেছন দিকে চলতে হয়। না হয় থেমে যেতে হবে। মানব জাতির জন্য থেমে যাওয়া মানে, বিপদ। আর পেছন দিকে যাওয়া মহাবিপদ।

আপনি কখনো চিন্তা করে দেখেছেন এ দেশের মানুষ না খেয়ে থাকে কি না? ৯৯% মানুষ হয়তো আপানাকে বলবে, না কেউ না খেয়ে থাকে না। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা উল্টো। কেউ কেউ না খেয়ে থাকে। আসলে না খেয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এর জন্য দায়ী সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। কেন না, তারাই দেশটাকে শাসন করে।  স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশের মহানগরে বসবাসকারী পরিবারগুলোতে ৮.২২ মানুষ না খেয়ে রাত কাটায়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এ সংখ্যাটা আরো বেশি  ৯.২৩।  এছাড়া ৩ শতাংশ পরিবারের সদস্যদের কখনো কখনো কি দিন কি রাত খাদ্যই জুটে না! এ তথ্য জাতীয় পত্রিকায় এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো ( বিবিএস) এর জড়িপের কল্যাণে। ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২৬ ডিসেম্বরের জড়িপ। যদিও পত্রিকায় এসেছে কয়েক দিন আগে। অথচ এ দেশের টাকা লুট করে কানাডায় বেগম পাড়া তৈরী হচ্ছে! ভারত, পাকিস্তানের অবস্থাও তথৈবচ। পাকিস্তানের রাজনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের লুটপাটে দেশটির জনগনের অবস্থা খুবই নাজুক। তার উপর মোল্লাদের জেহাদি জোসে দেশটা তো ভাসছেই। শোষন ও লুটপাটে  ভারতের রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরাও পিছিয়ে নেয়। গত ৭২ বছরে ভারত ও পাকিস্তানের আমজনতার ভাগ্যের মৌলিক কোন পরিবর্তন আসেনি। কেবল মুষ্টিমেয় রাজনীতিক, সেনাকর্মকর্তা, আমলা, মোল্লা পুরোহিত ও লুটেরা ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। বা তারা অর্থে বিত্তে বৈভব খ্যাতিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।  

এ উপমহাদেশ পারস্য লুটেছে। তুর্ক ও আফগানেরা লুটেছে। ফরাসি ও ওলন্দাজ লুটেছে। ইংরেজরা তো প্রায় আড়াশত বছর লুটেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সাড়া পৃথিবীর ২৫% অর্থ সম্পদ এ উপমহাদেশেই ছিলো! অথচ আরব রাষ্ট্রগুলোতে এ উপমহাদেশের মানুষের পরিচয় "মিসকিন"! ইউরোপে আমাদের পরিচিতি 'দরিদ্র ও অসভ্য'!

এসব গভীর চিন্তার বিষয়। তা চিন্তাটা করবে কে বা কারা? আমরা তো চিন্তক তৈরী করছি না। কেবল অনুগত নাগরিক তৈরী করছি। 

আরব, তুর্ক, আফগান, উজবেকরা আমাদের দাস বানাতো আগে। লোভ দেখিয়ে, মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে দাস বানাতো। বৃটিশরা আমাদের পূর্বপুরুষদের বানিয়েছিলো প্রজাদাস। 

আমরা রাজনীতিতে রাজনৈতিক কর্মী চাই না, 'সেবাদাস' চাই। এবং পেয়েও যাই পালে পালে। ! এখন আমরা পিটিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কেবল  অনুগত ও বিনয়ী মানুষ তৈরী করে চলছি। এই পিটুনি খাওয়া অনুগত ও বিনয়ীরা একদিন মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠে। কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবনার মানুষগুলো, বিনয়ী হতে পারে অনুগতও হতে পারে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা মানুষ ও মানবতার জন্য হুমকি। বিনয়ী ও অনুগতরা সুবিধাবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক। বিনয়ী ও অনুগতরা কখনো চিন্তক হতে চায় না। যে সমাজে ও রাষ্ট্রে চিন্তকদের জায়গা নেই। সে সমাজ ও রাষ্ট্র দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, অপশক্তি ও অন্ধকারবাদীদের দখলে যাবেই। 

(www.theoffnews.com - Bangladesh name religion hight colour country)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours