সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

ভারতীয় বামপন্থী নেতা তথা সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির কাছে আমার একটি জিজ্ঞাস্য আছে। বেলারুশের বিরোধী নেত্রী তথা বামপন্থী সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়ার সম্পর্কে আপনাদের দলগত অবস্থানটা আদৌ কি? আজ পর্যন্ত কেন একটা বিবৃতিও তাঁর সম্পর্কে আপনারা খরচ করবার ফুরসৎ পাননি, একটু বলবেন।

আপনি অনায়াসেই বলতে পারেন এটা বেলারুশের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তাই মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তাই নাকি? সেটাই যদি হয় তো উঠতে বসতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তো আপনারা সমালোচনায় সর্বদাই মুখর। তাহলে সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়ার দেশাত্মবোধ জাগরণের এই অদম্য যুদ্ধকালের বেলায় আপনারা স্পিকটি নট্ কেন? তিনি তো প্রকৃতই আদ্যন্ত বামপন্থী নেত্রী। তারপরেও উনার প্রতি আপনাদের এত শীতলতা কেন?

৩৭ বছরের তন্বী সুন্দরী যুবতী এই সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়া। এই বছরের একদম গোড়াতেও তিনি তো ছিলেন এক অচেনা প্রান্তিক স্কুল শিক্ষিকা। স্বামী ব্লগার। দুই সন্তানের একদম সাদামাটা জননী। তবে বরাবর বামপন্থায় ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। একইসঙ্গে জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রের প্রতি তিনি ছিলেন যথেষ্ট আস্থাশীল। আক্ষরিক অর্থে তিনি কোনও ভাবেই পরিচিতি মুখ ছিলেন না কিছুদিন আগেও।

গত অগস্ট মাসে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশবাসীকে চমকে দিয়ে আচমকাই প্রার্থীপদে দাঁড়িয়ে পড়লেন এই আপাদমস্তক শিক্ষিকা সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়া। প্রবল পরাক্রমী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে একেবারে রাজনীতির আনকোরা এই শিক্ষিকাকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়ে দেশবাসী পরিবর্তনের স্বপ্নে উদ্বেল হয়ে উঠেন। কিন্তু কেন জানেন? 

১৯৯৪ সাল থেকে ক্ষমতায় আসীন এই প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো ইতিমধ্যেই ইউরোপের অন্যতম স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর দমননীতি ও আর্থিক মন্দাকরণের দায়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল আমজনতা। তাঁরা মুক্তির স্বাদ খুঁজছিল। তাই উদারচেতা আধুনিকা বাম মতবাদী অথচ গণতন্ত্রকামী এই শিক্ষিকাকে ভোট ময়দানে পেয়ে দেশবাসী দুই হাত তুলে তাঁকে সমর্থন জানান। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাঁর প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে। এরমধ্যেই নির্বাচনের ফলাফলে একতরফা ভাবে জয়ী ঘোষণা করা হয় আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোকে। কিন্তু পশ্চিমী দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ সহ বেলারুশের বৃহত্তর অংশের জনগন এই ফলাফলকে মেনে নিতে পারেনি। সবাই একযোগে বলতে শুরু করেন, ভোটে জয়ী হয়েছেন আসলে সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়া। কিন্তু শাসক সরকার জালিয়াতি করেছে ভোট গননায়। প্রতিবাদে শুরু হয় দেশ জুড়ে গণবিক্ষোভ। সরকারি স্পন্সরশীপে চলতে থাকে বিদ্রোহ দমনের নামে অবাধ গ্রেফতার ও খুন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে দুই সন্তানের প্রাণনাশের আশঙ্কায় এই সর্বহারা নেত্রী নিজের দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন। পার্শ্ববর্তী দেশ লিথুয়ানিয়াতে তিনি আশ্রয় নিয়ে ঘোষণা করেন, "বেলারুশের এই নির্বাচন স্রেফ একটা নাটক ও তামাসা। আমি দেশবাসীর সঙ্গে আছি ও থাকব। ভেবেছিলাম এই নির্বাচন আমাকে অনেক বড় দায়িত্ব দেবে। আমি হতেই পারি একজন নারী। মনে রাখবেন আমার এই লড়াই আমৃত্যু জারি থাকবে। আমি বেলারুশের নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখি।" 

এই ঘটনা প্রবাহের চার মাস পরেও কেমন যেন চুপচাপ ভারতীয় বাম শিবির। ভারতীয় বাম নেতৃত্ব হামেশাই দাবি করেন, তাঁরা সর্বহারার প্রকৃত বন্ধু ও স্বৈরাচারীর শ্রেণিশত্রু। আর সেটাই যদি হবে তাহলে বেলারুশের এই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের প্রসঙ্গে এমন উদাসীন কেন সীতারাম ইয়েচুরি এন্ড হিজ কোম্পানি। কেন তাঁরা একটিবারের জন্যও নৈতিক সমর্থন জানালেন না আজ পর্যন্ত নির্বাসিতা বাম জননেত্রী সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়াকে? আপনারা যে আন্তর্জাতিক বিষয়ে অতি উৎসাহ দেখান না এমনটা তো নয়। ইরাকের যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছিল। একটি প্রতিনিধি দলের হয়ে রাজ্যসভার এক সিপিএম সাংসদ ইরাক সফরে যান সেই সময়ে। সফর শেষে ফিরে এসে সেই সাংসদ কতটা উচ্চস্বরে ইরাকের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমেরিকার নিন্দা করেছিলেন তা আজও অনেকের স্মৃতিচারণায় স্পষ্ট। এমনকি একান্ত আলাপচারিতায় সেই সাংসদ আমাকে বলেছিলেন ইরাকের একটি হোটেলের মেঝেতে ছিল তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ছবি। প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি ওই ছবি পা দিয়ে মারিয়েও ছিলেন। এমনই বিপ্লব যাঁদের ধমনীতে বইছে সেই দলের কুশীলবেরা কি অদ্ভুত শীতঘুমে আচ্ছন্ন বেলারুশের সাম্প্রতিকতম প্রসঙ্গে। 

বেলারুশের প্রতিটি অলিতে গলিতে যখন আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর পুলিশ বাহিনী বন্দুকের যথেচ্ছ তান্ডব চালাচ্ছে, জনসাধারণের গ্রেফতারের সংখ্যা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে জেল ভরোর স্হান হয়ে গেছে বড্ড সংকুলান, তখন স্বাভাবিক ভাবেই গণ আন্দোলনের জেরে শাসকের পদত্যাগের দাবি ক্রমেই জোরালো হতে থাকে বেলারুশের প্রতিটি জনপদে। দেশবাসীর এমনই এক দাঁতচাপা গণরোষ কালে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর ত্রাতা হিসেবে পরিশেষে পাশে এসে দাঁড়ালেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। রাশিয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দিয়ে বসলেন আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোকে। সমগ্র ইউরোপের দেশগুলি যেখানে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে উদগ্রীব সেখানে পুতিন হাঁটলেন সম্পূর্ণ উল্টো রাস্তায়। তা হোক না ওই ছোট্ট দেশটিতে যতই বামপন্থার বিরুদ্ধচারণ। ক্রেমলিং কিন্তু অবশেষে স্বৈরাচারী শাসনের পথকেই ফের সুগম করলো বেলারুশে। 

আসলে বামপন্থার অন্যতম মাতৃভূমি যে রাশিয়া। যেখানে রুশ সিংহাসনের বর্তমান গডফাদার পুতিন স্বয়ং হাঁটছের বামপন্থার টুঁটি টিপতে বেলারুশের লালভূমিতে, সেখানে ভারতীয় বাম নেতৃত্ব কিভাবে সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়ার পাশে দাঁড়াতে পারে? তাই না? আসলে ভারতীয় বাম নেতৃত্বের কাছে বামপন্থার অর্থটাই যে হল অন্য। বাম আন্দোলন বা বাম ইস্যু বা গণ আন্দোলন বা দেশাত্মবোধের গণ লড়াইয়ের মতো বাস্তবসম্মত ইস্যুগুলিকে মারো গোলি। রাশিয়া ও চিন-স্রেফ নামই কাফি হ্যায়। তা হোক না রাশিয়ার বেলারুশ বামের প্রতি বিরুদ্ধচারণ কিংবা চিনের ভারতীয় ভূখণ্ডের আগ্রাসন নীতি। চুলোয় যাক যত সব না-পছন্দ ইস্যু। যুগ যুগ জিও রাশিয়া ও চিন নামক শুধুমাত্র নামগুলো। তাতে উপেক্ষিত না হয় থাকলো বেলারুশের বাম জননেত্রী সিভেৎলানা তিখানোভস্কায়া। ভারতীয় বামেদের ভারি বয়েই গেল। গুরু পুতিন, গুরু জিনপিং, গুরুদেব রাশিয়া-চিন...

(www.theoffnews.com - Russia Belarus Putin Tramp Iraq Sitaram yeachuria Aleksandar Lukasenko Svetlana Tikhanovskaya)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours