শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

কি লিখবো? ভাবছি। এমন একটি দেশে বাস করি যেখনে অনেকের 'আদর্শ' এমন একজন ব্যক্তি, যিনি মনে করেন, মেয়েদের ক্লাস ফোরের বেশি পড়ার দরকার নেই! হ্যাঁ আজকাল লিখতে গেলে ভাবতে হয়। একবার নয়, দুবার নয়, দশ বার ভাবতে হয়। কারন "এ যুগে কেউ ছেলেদের মাদরাসায় পড়ায়? ২০২০ সালে এমন ননসেন্স  থিউরি মাথায় আসে কিভাবে? এগুলো মাথায় ঢুকায় কে?" ব্যাস, এতটুকু লেখার জন্যই মামলা হয় এবং গ্রেপ্তার করে হাজতে ভরে  রাখে! মাদরাসা তো দুরের কথা, স্কুল, কলেজ  শিক্ষকদের কথা শুনলেও আজকাল ভয়ে শিউরে উঠি। একজন শিক্ষক যদি বলেন, নারীদের পড়া লেখা করার দরকার নেই! অথবা পড়া লেখা করলেও চাকরীর করার দরকার নেই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাও আবার বিজ্ঞানের, তিনি যদি বলেন, "আকাশ সাতটি"! এমন একটি সমাজে বসবাস করে, তখন কারো সম্মুখে কথা বলতে ভয় হওয়ারই কথা। সাপ দুধ খায় না বললে, যে সমাজে তিরস্কৃত হতে হয়, এমন কি কপালে মারও জুটতে পারে। সে সমাজে বসে কি লিখবো! যেখানে সাপে দুধ খায় না, বলা যায় না৷ সেখানে ডারউইনের বিবর্তন বাদ নিয়ে কিভাবে কথা বলবেন? নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম দিনে ফেসবুকে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর নিউজ-ফিডে আমজনতার মন্তব্যসমূহ পড়লে, যে কোন সুশিক্ষিত ও সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। এক কিম্ভূতকিমাকার, ধর্মান্ধ ও পুরুষতান্ত্রিক প্রজন্ম নিয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ! বেগম রোকেয়াকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি তো করছেই, সেই সাথে "জাহান্নামের টিকিট" ধরিয়ে দিচ্ছে। বেগম রোকেয়া আজ বেঁচে থাকলে, জেল জরিমান তো দূরের কথা, তাকে জবাই করে দিতো তাতে সন্দেহ নেই। নজরুলকে নিয়ে আপদত এরা নীরব। কারন এখনো  রবীন্দ্রনাথকে ঠেকাতে নজরুলের বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না! এক সময় নজরুল ইসলামকেও মূর্খ, কাফের, মুরতাদ, নাস্তিক বলা হতো। 

বেগম রোকেয়ার উপর অনেকের এত রাগ ও ক্ষোভ কেন? কারন তিনি একযোগে পুরুষতন্ত্র ও ধর্মকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। "পুরুষ" তার "সুলতানার স্বপ্ন"কে পুরুষতন্ত্রের উপর আক্রমন মনে করে। আর তিনি মনে ধর্মশাস্ত্রসমূহ পুরুষ সৃষ্ট। এসব কারনে হয়তো বেগম রোকেয়ার উপর এত ক্ষোভ! 

অবাক করার বিষয় রংপুরে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য উন্মুক্ত করার সময় প্রশাসনের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এমন কি স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও দেখা যায়নি বলে শুনেছি! এটা অশণিসংকেত।  আসলে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ধর্মন্ধতা ও নারী বিদ্বেষ এত বেড়ে গেছে যে নেতারাও অনেক বিষয়ে অংশ নিতে ভয় পায়। এমনকি প্রশাসনও। কিন্ত এ ভয় একটি জাতির জন্য যে কত ক্ষতিকর তা বলার সময় হয়নি। তবে এই ভয় ও আসকারার পরিণতি আন্দাজ করার করা যায়। যার উত্তম দৃষ্টান্ত আজকের আফগানিস্তান। 

"বাচ্চাদের মারবেন না" এমন কথা আপনি অনেক মা- বাবার সামনে বলতে পারবেন না। এমনকি অনেক শিক্ষকের সামনেও না। শিক্ষকেরা তাদের কুযুক্তি তুলে ধরে বলেন, এটা আমেরিকা ইউরোপ নয়! এতটুকু বলেই খান্ত হন না। বলেন, না পেটালে ছাত্ররা "মানুষ" হবে না! আগে পিটিয়েছে বলেই মানুষ হয়েছে! এদেশে যেমন কোচিং সেন্টারগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের  পেটানো হয়, তেমনি  প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুল  পেটানো হয়, এমনকি কিছু কিছু কলেজেও। যদিও ছাত্রদের পেটানো ফৌজদারি অপরাধ। যে দেশে শিক্ষকেরাই নিয়মিত শারিরীক আঘাতের মাধ্যমে ফৌজদারি অপরাধ করে; সে দেশে ছাত্ররা মানবিকতা ও মানবাধিকার কি শিখবে? 

এ সমাজে কথা বলা মুশকিল, অনেকেই বলে আগের দিনের মানুষ বেশি দিন বাঁচতো! যদি বলি তাহলে আগের দিনের মানুষের গড় আয়ু  এত কম কেন? এর কোন জবাব না দিয়ে  বরং "সাওয়াল করনা হারাম হ্যায়, জওয়াব দেনা গুসতাখি" এরকম ভাব ধরেন অনেকেই।

অলিখিত ভাবে এখানে সওয়াল ও জবাব  নিষিদ্ধ। তাই লিখতে ভয় হয়। কিন্তু কতক্ষন চুপ থাকা যায়? যখন সাদাকে বলা হয় কালো, কালোকে বলা হয় সাদা! খুনি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না। শাসকের শাসনকার্য তো নয়ই, তাদের অপশাসনের সমালোচনাও নিষিদ্ধ। ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের নিয়মিত  মিথ্যাচারের সমালোচনা করা তো যথারীতি মৌচাকে ঢিল দেওয়া। এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় বন্দি থেকে কিইবা লেখা যায়। এখানে তো সাওয়াল করনা হারাম, হ্যায় জওয়াব দেনা গুসতাখি! যে সমাজে প্রশ্ন ও উত্তর নিষিদ্ধ, সে সমাজ বন্ধ্যা। যে সমাজে প্রশ্ন নেই উত্তর নেই। সে সমাজে নেই সৃষ্টি ও আবিষ্কার।

(www.theoffnews.com - Begum Rokeya Bangladesh)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours