প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র, লেখক, কালনা, পূূর্ব বর্ধমান:

মোক্ষলাভের জন্য নিজের পরিবারের তিন বছরের শিশু কন্যাকে বলি? তাও আবার এই ঘটনা ঘটছে এই শতাব্দীতে। এই অমানবিক ঘটনা প্রমান করছে আমরা আবার কুসংস্কারের যুগে ফিরে যাচ্ছি। গত ৬ ই জুলাই, ২০১৯ আসামের উদলগুড়ির গনকপাড়া গ্রামের শিক্ষকের পরিবারে এহেন কান্ড সারা দেশকে হতচকিত করেছিল। প্রশ্ন উঠছে পারিবারিক বন্ধু তান্ত্রিকের পরামর্শে এমন ঘটনা একজন শিক্ষক কি ভাবে করতে পারেন? ঘটনার সময় গ্রামের প্রতিবেশীরা ওই বাড়িতে গিয়ে দেখেন রুদ্ধদ্বার বাড়িতে সকলে উলঙ্গ হয়ে যজ্ঞবেদির সামনে বসে এক শিশুকন্যাকে বলি দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিশুটি আবার একই পরিবারের। সঠিক সময়ে গ্রামবাসীরা এবং পুলিশ উপস্থিত না হলে শিশুকন্যটির মৃত্যু হতো বলিতে। 

এর পিছনে শুধুই কি কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস? 

আমার মনে হয়েছে-

প্রথমত: গোটা পরিবারের সকলকে সম্মোহিত করেন এসময়ে তান্ত্রিক। কোন কিছু মাদক দ্রব্য খাইয়ে গোটা পরিবারকে হয়ত চেতনারোহিত করে দেন। নয়ত পরিবারের শিশুটিকে চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা কি ভাবে দেখেন?

দ্বিতীয়ত: এর পিছনে অন্য কারন দীর্ঘদিনের ওই প্রদেশের রীতিনীতি। আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তন্ত্রসাধনার পীঠভুমি। একসময়ে কামাখ্যা, মায়াগ্রাম সহ আসাম ও অরুনাচলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল কালাজাদুর পীঠস্থান। এই জায়গাগুলোতে আমি নিজে গিয়েও তন্ত্রসাধনা, পিশাচ সাধনা দেখে এসেছি বেশ কয়েকবার। এমনকি এরা তন্ত্রসাধনার সময় কাঁচা মাংস এমনকি শ্মশানের আধ পোড়া মাংসও খায়।

ঋগবেদ, অথর্ববেদেও(৫/২৩,১৫/১৫, ২৬/১) এই অঞ্চলের মায়া বিদ্যার বিভিন্ন মন্ত্র শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায়। 

জাদু বিদ্যা বা তন্ত্র সাধনার দুটি দিক। শুক্লতন্ত্র (শুক্ল জাদু) ও কৃষ্ণতন্ত্র (কৃষ্ণ জাদু)। শুক্লতন্ত্রের সাধনার মাধ্যমে তান্ত্রিকরা মানুষের কল্যাণ করতে পারেন। এমন ভাবনা পাওয়া যায় তন্ত্র মতে। কিন্তু, কৃষ্ণতন্ত্রের সাধনার মাধ্যমে মানুষের ক্ষতিসাধন হয়। তান্ত্রিকরা যে ষটকর্ম প্রয়োগ করেন তা আসলে কৃষ্ণতন্ত্রের পর্যায়ভুক্ত। এর মধ্যে পরে বশিকরন, স্তম্ভন, বিদ্বেষন, উচাটন, মারন (লেখক অরুণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে পেয়েছি)। বেশির ভাগ তান্ত্রিক এই ষটতন্ত্রের সাধনা করেন। এক্ষেত্রে ওই শিশুকন্যাকে বলি দেওয়া আসলে ওই তান্ত্রিকের ষটকর্মেরই প্রয়োগ যা আসলে কৃষ্ণ তান্ত্রিকতা। 

এই সব অন্ধ বিশ্বাস আজকের বিজ্ঞান নির্ভরতার সাথে সাথে বহু মানুষের মধ্যেই আছে। বিজ্ঞানের আলোকশিক্ষার অন্তরালে অন্ধকার ভারতে এই অন্ধ ও কুসংস্কার বিভিন্ন রাজ্যেই আছে শুধু আসামে নয়। আমার মনে হয়েছে এই শিক্ষকের মধ্যেও সেই অন্ধবিশ্বাসগুলি প্রকট ছিল। যে কারণেই গ্রামবাসীরা বাধাদানের কারনে উনি তাঁদের উপর ও পুলিশের উপর বাড়ির ঘটি, বাটি, বিভিন্ন জিনিস ছুঁড়ে প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন। যাঁর কারণেই পুলিশকে ৫ রাউন্ড গুলিও ছুড়তে হয়েছে। 

আমাদের রাজ্যে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষত যে অঞ্চলগুলোতে কামতাপুরীরা বসবাস করেন তাছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্ন জাতির মানুষের মধ্যে ও আদিবাসীদের মধ্যে এইরকম তান্ত্রিক প্রভাব আজও আছে। আদিবাসীদের মধ্যে ডাইনি বলে পিটিয়ে মেরে ফেলার কথা প্রায়শই বিভিন্ন পত্রিকায় খবরের শিরোনামে স্থান পায়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্ধান নিলে দেখা যায় এই ধরনের মানুষগুলির বিজ্ঞান নির্ভরতা বা বিজ্ঞানের আলোক এদের কাছে পৌঁছায়নি এমনটা কিন্তু নয়। বরং এরা বিজ্ঞানের সবরকম সুফলগুলি ভোগ করেও দীর্ঘদিনের পারিবারিক অন্ধবিশ্বাসগুলিকে ছাড়তে পারেনি বা ছাড়তে চায়নি। এরা টেলিভিশন ব্যবহার করে, বিদ্যুতের সুফল নেয়, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অথচ কুসংস্কার আচ্ছন্ন। নরবলি অনেকাংশে আজ আমাদের দেশে বন্ধ হলেও এরাই পশুবলির পক্ষে নির্লজ্জের মত আওয়াজ তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়। 

জানি না কবে এই কুপ্রথাগুলি থেকে এদেশ মুক্ত হবে?

(ছবি সৌজন্যে: প্রতিবেদক)

(www.theoffnews.com - human sacrifice prejudice)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours