শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

পৃথিবীতে একটি রাষ্ট্র এমনকি একটি সমাজও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করলে নিন্দিত হয়। অথবা স্রষ্টার অস্তিত্বে আস্থা রাখলে জেল হয়, পেটানো হয় বা হত্যা করা হয়। স্রষ্টায় বিশ্বাসী হওয়ার কারনে কেউ পরিবার থেকে বহিস্কৃত হয়েছেন। তাও শোনা যায়নি। তবে এর বিপরীতটা অহরহ ঘটতে দেখা যায়। যদি কেউ স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে। স্রষ্টায় অবিশ্বাসী হলে তাকে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ও সমাজে নিন্দিত হতে হয়। শারীরিক আক্রমন হতে পারে। জেল হয় এমনকি কোন কোন দেশে আইনত মৃত্যুদন্ড হতে পারে। অদ্ভূত বিষয় হলো, স্রষ্টায় অবিশ্বাসী হলে শাস্তি দেয় মানুষ! 

ফিলিপিনো প্রেসিডেন্ট বলেছেন, 'যদি স্রষ্টা থেকে থাকে তবে তার সাথে সেলফি তুলে দেখাও!' ওটা ফিলিপাইনে বলা সম্ভব এবং তারপর প্রেসিডেন্ট থাকাও সম্ভব। আমার সমাজে এমন কথা বললে, তার লাথি-গুঁতো খাওয়া নিশ্চিত! জেল হাজত বাসের সম্ভাবনা প্রবল। আর দেশের কোন কর্নধার এমন কথা বললে, তার ক্ষমতার কুর্শি হারানো সম্ভবনা শতভাগ। এটা হলো, তাদের ও আমাদের সমাজের চিন্তা -চেতনা, বাকস্বাধীনতা সহনশীলতার পার্থক্য। 

আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমি কেন স্রষ্টায় বিশ্বাস করি? কি উত্তর দেবো! আমি স্রষ্টাকে দেখেছি? বা স্রষ্টা এসে বলে গেছেন আমিই তোমার স্রষ্টা! অথবা স্রষ্টা তার কোন প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছেন, স্রষ্টা আছেন। না, স্রষ্টায় বিশ্বাসী হওয়ার দলিল হিসেবে এসবের কোন উত্তরই বর্তমানে কেউ গ্রহন করবে না। এমন দাবী, হয় হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেবে। না হয় কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাসীরা, ধর্ম অবমাননার মামলা দিয়ে জেলে ভরে দেবে। অথবা সমাজের লোকজন যদি সদয় থাকে তবে উন্মাদ ভেবে এড়িয়ে যাবে। নির্দয় হলে, হত্যা করে ফেলবে! আর যদি কেউ বলে, আমি স্রষ্টাকে স্বপ্নে দেখেছি, তাই স্রষ্টায় বিশ্বাস করি। তাহলে প্রতিবেশীরা তাকে ভন্ড ও বদমাইশ বলবে। যদিও অনেকেই উপরিউক্ত এমন দাবীগুলো করে গেছেন। আমরা কেউ তাদের ভন্ড বা বদমাইশ বলি না। বরং আমরা তাদের এখনো ভীষণ, ভীষণ শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি তাদের জন্য জীবন দিতে এমনকি কারো জীবন নিতেও পিছ পা হই না। শুধু তাইই নয়, উপরিউক্ত দাবীকারী ব্যক্তিদের মহামানব মনে করি। তাদেরকে প্রচলিত আইনের উপরে স্থান দিয়ে রেখেছি। এমনকি অতীতকালে উপরিউক্ত দাবী করা মানুষজনদের বিরুদ্ধে কেউ কোন সমালোচনা বা তাদের নিয়ে কোন প্রকার নেতিবাচক প্রশ্ন তুললেই জেল ফাঁসি হবে এমন আইনও করে রাখা হয়েছে। এবং মরে যাওয়ার পর নরকে আগুন দিয়ে পোড়ানোর শাস্তি তো সংরক্ষণ করা আছেই! 

আমি স্রষ্টাকে নিজের চোখে দেখিনি, এমনকি  স্বপ্নেও দেখিনি। অথবা স্রষ্টা কোন প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমাকে বলেননি, তিনি আছেন। আমি ওসবের দাবিও করিনি। তবে কেন স্রষ্টায় বিশ্বাস করি? হ্যাঁ, সে বিষয়েই কথা বলছি। আমি এ জন্য স্রষ্টায় বিশ্বাস করি, কারন আমার মা - বাবা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। আমার আত্মীয় -স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীরা সকলেই স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। দেশের সকল ব্যবসায়ী প্রশাসক,আইনবিদ, সাংসদ স্রষ্টায় বিশ্বাসী। সকলে এজন্য বললাম, কারন এদের কেউ স্রষ্টায় অবিশ্বাস করেন, তা কখনো প্রকাশ্য বলেননি। দুচারজন হয়তো স্রষ্টায় অবিশ্বাসী রয়েছেন, তারা পারিবারিক চাপ, চাকরি, ব্যবসা, ভোট, ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নীরব থাকেন। সে তো ভিন্ন বিষয়। আমার দেশ ও সমাজের ধনী গরীব শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই স্রষ্টায় বিশ্বাস করে। আমার সমাজে একজন চার বছরের শিশু থেকে ১০৪ বছর বয়সী মানুষও স্রষ্টায় বিশ্বাসী। এ অবস্থায় কার সাধ্য আছে স্রষ্টায় অবিশ্বাসী হওয়ার! কারো সাধ্য নেই। 

আমার মা -নানী ও বাবা -দাদা কেন স্রষ্টায় বিশ্বাস করতো? কারন তাদের মা-বাবা, প্রতিবেশি ও সমাজের সকলে স্রষ্টায় বিশ্বাস করতো। সবাই বিশ্বাস করলেই তা কি সত্য হয়ে যাবে? বা তার অস্তিত্ব বিদ্যমান হবে? ইতিহাস তা বলে না। পৃথিবীর সকলেই যখন বিশ্বাস করতো পৃথিবী স্থির। তখন প্রথমে একজনই বলেছিলেন, পৃথিবী স্থির নয়। ঘুর্ণয়মান। এ কথা বলার জন্য  কয়েকজনকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি পৃথিবী ঘুর্ণয়মান বলার অপরাধে পুড়িয়েও মেরে ফেলা হয়েছে! আজ কিন্তু পৃথিবীর সেই মুষ্টিমেয় দুচারজনের কথাই সত্য প্রমানিত হয়েছে। সে সময়ের পৃথিবীর সকলের 'বিশ্বাস' আজ মিথ্যা! তাই সংখ্যা দিয়ে সত্য নির্ধারন সব সময় সঠিক হয় না।

আমি কেন স্রষ্টায় বিশ্বাস করি? কারন,আমি আমার সমাজে কাউকে বলতেই শুনিনি বা শুনছি না, স্রষ্টা বলতে, কিছু নেই। এছাড়া আমার সমাজে তিন ধর্মের সাতটি উপাসনালয় রয়েছে। সেখান থেকে তারা প্রতিনিয়ত শিক্ষা দিচ্ছেন স্রষ্টা আছেন। আমরা যারা সেখানে উপাসনা করি তারা সকলেই স্রষ্টায় বিশ্বাসী, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কোন সন্দেহ নেই, আমরা সমাজের সকলে স্রষ্টায় বিশ্বাসী । কিন্তু ঐ তিন উপাসনালয়ের সুবাদে আমাদের স্রষ্টা বিশ্বাস কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন এবং বিপরীত!  স্রষ্টাদের ভাষাও ভিন্ন। একই মাটি, আলো -বাতাসে, মরি বাঁচি। একই খাবার খেয়ে বড় হয়েছি। একই  সমাজে ও পাশাপাশি বসবাস করলেও স্রষ্টায় বিশ্বাসের বেলায় যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। সেই সাথে স্রষ্টায় বিশ্বাসগুলো আবার পরস্পর বিরোধী। আমাদের তিন ধর্মের স্রষ্টার নাম ও বিশ্বাসের ভিন্নতা, পরস্পর বিরোধীতা থাকলেও, ডারউইনের মতবাদ সামনে এলে আমরা ঐক্যজোট হই, একযোগে আক্রমন করি! কারন, ডারউইনবাদ স্রষ্টার অস্তিত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। 

আমরা স্রষ্টায় বিশ্বাস করি। কারন, আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলো বলেছে, স্রষ্টা আছেন। অসীম ক্ষমতাধর ধর্মেবেত্তারা মানেন ও মানান; স্রষ্টা আছে। অনেক ধর্ম যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক স্রষ্টা। প্রত্যেক স্রষ্টার নাম, কর্ম, আদেশ- নিষেধ, উপদেশ ও গুণাগুন পৃথক পৃথক। অবশ্য বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ এ বিষয়ে ব্যাতিক্রম। বৌদ্ধ ধর্মগুরু ও বৌদ্ধ ধর্ম, স্রষ্টার বিষয়ে একেবারে নীরব! বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে স্রষ্টার কোন নাম নেই। আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি কারন, আমাকে শেখানো হয়েছে, জানানো হয়েছে, সৃষ্টি আছে মানেই স্রষ্টা আছে। তা না হলে এ আকাশ বাতাস পাহাড় পর্বত বৃক্ষ নদীনালা মানুষজন এলো কোথা থেকে? স্রষ্টা আমাদের খাওয়ায়, পরায়ও। তবে স্রষ্টা থাকতে মানুষ কেন বিনা চিকিৎসায় ও না খেয়ে মরে। বা স্রষ্টার সৃষ্টি কর্তা আছে কি না, সে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তা ভয়াবহ অপরাধ। স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আরো একটি যুক্তি দেওয়া হয়, আমার মা যেমন আমাকে বলেছেন, আমার বাবা কে। তেমনি মহামানবেরা তথা ধর্মপ্রবক্তারা বলে গেছেন, স্রষ্টা কে। স্রষ্টার অস্তিত্ব ও স্রষ্টার আদেশ নিষেধ নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই। তেমনি যে বা যারা স্রষ্টার অস্তিত্বের কথা আমাদের শুনিয়েছেন, তাদের কথা, কাজের বিষয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ পোষণ করারও অধিকার রহিত করা আছে।ধর্মশাস্ত্রগুলোতেও এমন নির্দেশনা দেখি।

তাই আমি বিশ্বাস করি, স্রষ্টা আছেন। স্রষ্টাকে কেন দেখা যায় না? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমরা শিখেছি, বাতাস তো দেখা যা না। শারীরিক ব্যাথা ও মনের কষ্টতো দেখা যায় না। তেমনি স্রষ্টাকেও দেখা যায় না। তাই আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি! এই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে আসলেই কি এসব স্থুলযুক্তি ও বিশ্বাসের কারনেই আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি? নাকি আমার এ স্রষ্টায় বিশ্বাসের পেছনে আরো অন্য কোন কারন আছে? রাষ্ট্র, সমাজ, উপাসনালয় ও পরিবারের প্রতিনিয়ত প্রচারের প্রভাব ও চাপ নেই তো আমার উপর? আমার অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ভীতি, প্রশ্নহীনতা, যুক্তি ও বিজ্ঞান বিমুখতা আমাকে স্রষ্টায় বিশ্বাসী হতে বাধ্য করেনি তো!

(www.theoffnews.com - Bangladesh He Supreme)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours