সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

গতকাল দুর্গাপুরে বিজেপির প্রকাশ্য মঞ্চে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও দলীয় সাংসদ অর্জুন সিংয়ের হাত থেকে গেরুয়া পতাকা গ্রহণ করলেন রাজু ঝাঁ। অতএব এখন থেকে রাজু ঝাঁ সক্রিয় ভাবে বিজেপি সদস্য। সাবাশ। দে তালিয়া। কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া বলে যিনি খনি এলাকায় সু(কু)পরিচিত তিনি কিনা পদ্ম বাগানের নয়া সম্পদ। হায় বাংলা। হায় হায় হায় বিজেপি। কি খেল দেখালে মাইরি। 

গেরুয়া শিবিরে এই যোগদান নিয়ে যে সমালোচনা হবেই তা কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন দিলীপ ঘোষ। তাই তিনি রাজু ঝাঁর বিজেপিকরণ প্রসঙ্গে উল্টে প্রশ্ন করে বসলেন, "তোমাদের সঙ্গে থাকলে সুখ্যাত আর আমাদের সঙ্গী হলে কুখ্যাত?"

সত্যি রাজু ঝাঁর মতো স্বনামধন্য মাফিয়ার অদ্ভুত ওজন আছে মানতেই হয়। খনি দৌলতে প্রতিষ্ঠিত বাহুবলী ও অর্থবলী বলে কথা। নাতো বিজেপি রাজ্য সভাপতি স্বয়ং তাঁর হয়ে সাফাইবা গাইবেন কেন একেবারে প্রকাশ্যে? আর দলেই বা তাঁকে অন্তর্ভুক্তি করাবেন কেন? আসলে এই 'কেন'র ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। সিপিএম আমলে কয়লা লুঠ চলেছে একেবারে গ্র্যাসরুট লেবেলে। তৃণমূলের আমলেও এই কয়লা কীর্তনের একই অভিযোগ উঠেছে বারবার। আবার বিজেপির এই পদক্ষেপে, অনেকেই মনে করছেন তারা ২০২১'এ রাজ্যে ক্ষমতায় যদি আসতে পারে তবে বিজেপির মদতেও চলবে কালো হীরের নগদ নারায়ন হরিলুঠ। উফ্ কি কয়লা লুঠপাটের আগাম গেমপ্ল্যান। যুগ যুগ জিও কয়লা মাফিয়া। রাজু-লালা-রাজু কয়লা সিরিজ চলছে চলবে। রাজুর ঘাড়ে বন্দুক রেখে অবৈধ খনি দখলের গেরুয়া ব্লুপ্রিন্ট তবে তো এখনই খুল্লামখুল্লা। 

এই রাজু ঝাঁ একসময় রানিগঞ্জের কয়লা মাফিয়া সূরজ উপাধ্যায়ের মুন্সী হিসেবে কাজ করতেন। অসম্ভব ঠান্ডা মাথা, সদা মিষ্ঠভাষী, অসাধারণ জনসংযোগ, মাফিয়া দল সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা, অমায়িক ব্যবহারের দৌলতে অচিরেই তিনি স্থানীয় তদানীন্তন সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরীর নজরে চলে আসেন। এমনই ফিসফাস রানিগঞ্জের নানা মহল্লায়। এটাও নানা সূত্রে শোনা যায়, বংশগোপালের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদের বদান্যতায় রাজুর জেট গতির উত্থান হয় তখন থেকেই। রাজুর সঙ্গে সিন্ডিকেটের তখন হাত মেলায় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও নারায়ন নন্দার মতো মাফিয়ারা। ধানবাদ থেকে কলকাতা এক চেটিয়া রাজুর প্যাডে শুরু হয় অবৈধ কয়লার বিশাল নেটওয়ার্ক যজ্ঞ। মাসোহারায় সবচেয়ে বড় অংশ চলে যেত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে। একে একে রাইটার্স বিল্ডিং, লালবাজার ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কিছু উর্ধ কর্তাদের কাছে পৌঁছে যেত সাদা খাম। এমনকি প্রয়াত এক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গেও তার লেনদেনের রফা চলতো বহাল তবিয়তে 'কমলদা' মারফৎ। কয়লাঞ্চলের বহু সিপিএম নেতা ও একাধিক সাংবাদিক তাঁর প্রসাদে ধন্য হতেন মাসোহারা সিস্টেমে। হাজার তিন কর্মচারী সামিল ছিল তার এই অবৈধ কয়লা কারবার অপারেশনে। ধীরে ধীরে বেআইনি কালো হিরে ইন্ডাস্ট্রির বেতাজ বাদশা হয়ে উঠেন এই রাজু ঝাঁ। এরই মধ্যে রাজুর এই কয়লা সাম্রাজ্যে মাথা ঢোকানোর অদম্য চেষ্টা করেন রাজ্যের প্রথমসারির এক নামী সম্পাদক-সাংবাদিক। যিনি 'চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে অনুকূল মাইতির সঙ্গে সেটিং' অভিযোগে বেশ কিছুদিন উরিষ্যার জেল হাজতে সম্প্রতি আটক ছিলেন সিবিআই গ্রেফতার করার পর। এখন অবশ্য তিনি জামিনে মুক্ত। এমনকি কয়লার রফা নিয়ে রাজু ঝাঁর সঙ্গে সেই সম্পাদক-সাংবাদিক গোপন বৈঠকও করেন স্থানীয় বিধাননগর এলাকার একটি গেস্ট হাউসে। কিন্তু বিধি বাম। বাম সরকার উল্টে গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের হাতে রাজু হলেন গ্রেফতার। আর সম্পাদক-সাংবাদিক মহাশয়ের তখনকার একটি পত্রিকা স্পন্সরশীপের স্বপ্নের নটে গাছটিও মুড়িয়ে গেল একইসঙ্গে।

রাজুর প্রস্থান তখন ঘটলেও অবৈধ কয়লা কারবার কিন্তু ফের চালু হয় বছর খানেক পর। বিজেপির অভিযোগ, এবার নাকি কয়লার মধু চুষতে স্বয়ং ময়দানে নেমে পড়েছেন 'ভাইপো'। এই ভাইপোই নাকি সামনে এজেন্ট খাড়া করে রাখেন নিতুরিয়ার কয়লা মাফিয়া লালাকে। ওরফে অনুপ মাজিকে। আর পর্দার পিছনে গোটা মসৃণ অপারেশনটা কন্ট্রোল হচ্ছিল ভাইপোর অঙ্গুলি লেহনে। কিন্তু মাস খানেক আগে লালাকে গ্রেফতার করতে উঠেপড়ে লাগে সিবিআই। গোপন সূত্রে জানা গিয়েছে, সিবিআইয়ের তাড়া খেয়ে লালা এখন দিল্লিতে রয়েছেন এই তদন্তকারী সংস্থারই সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। লালা নাকি কয়েকজন প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার নাম ফাঁস দিয়েছেন সিবিআইয়ের কাছে। যাঁরা নাকি অবৈধ কয়লা কারবার থেকে উপকৃত হয়েছেন। কয়লাঞ্চলের এমন সমালোচনাও শোনা যায়, আসানসোলের কোনও এক অতি প্রভাবশালী নেতার নাম লালা সিবিআইকে ফাঁস করে দেওয়ায় সেই নেতা নিজের গা বাঁচাতে অতিসম্প্রতি অতি বিপ্লবী হয়ে ওঠেন ও বিজেপিতে যোগ দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিজেপির আসানসোল সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র ঘোর আপত্তিতেই তাঁকে নাকি মাথা নিচু করে পুরোনো ঘরেই ফিরতে হয় তাঁর দলের কাছে ক্ষমা চেয়ে।

অন্যদিকে একটা সূত্রে প্রকাশ, রাজ্য পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির এক নেতার ছত্রছায়াতে এতদিন দিল্লিতেই বাস করছিলেন রাজু। যেই লালা কয়লাঞ্চলের রাজ্যপাট ফেলে সেই দিল্লিতে হাজির হতে বাধ্য হয়েছেন অমনি রাজু ফের উদয় হলেন দুর্গাপুরে। একেবারে সরাসরি পদ্মমঞ্চে সশরীরে। রাতারাতি রাজু হয়ে গেলেন গেরুয়া পোষাকধারী 'রাজুদা'। আর এহেন 'আমরা রাজুদার অনুগামী' হিসেবে পুনরায় এই শহর জুড়ে ভোজবাজির মতো প্রকাশ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উদয় হয়েছেন বেশকিছু রাজুর বেআইনি কয়লা কারবার এর পুরোনো সাকরেদরা। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর কথা বলছিলাম এআইসিসির সদস্য তথা পশ্চিম বর্ধমান জেলা কংগ্রেস সভাপতি দেবেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি কিন্তু আসল কথাটা বলে ফেললেন। তিনি জানান, বিজেপি ভেবেছে সামনের নির্বাচনে জিতে তারা রাজ্য সরকার চালাবে। তাই বিজেপি পূর্ব পরিকল্পনা করেই সিবিআই লেলিয়ে এখন থেকেই লালাকে হঠিয়ে দিল ভাইপোকে কয়লার মার্কেট থেকে ইনঅ্যাক্টিভ করতে। আর একইসঙ্গে দুর্গাপুরে রাজু ঝাঁকে বিজেপিতে জয়েন করিয়ে নিয়ে এলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারলো লালা-রাজু দ্বৈরথে। উদ্দেশ্য পরিস্কার, যদি গৈরিক বাহিনী রাজ্য শাসন করার মতো অবস্থায় আসে তখন এই রাজুকে সামনে এগিয়ে দিয়েই পিছন থেকে বিজেপি কুক্ষিগত করবে কালো হিরের কালো কারবার।

তাহলে সিবিআইয়ের এই যে লালা-বিরুদ্ধ অভিযান, তা কি কয়লার অবৈধ কারবার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে নয়? স্রেফ তোতা পাখি লেলিয়ে মৌরসিপাট্টা দখলের স্বপ্ন বিজেপির, তাই না? কি অদ্ভুত না? দাবার বড়ে হয়েই থেকে যায় এই রাজু-লালারা। বরাবর। যে যার মতো করে তাঁদের কয়লা ময়দানে নামিয়ে দেয় ও দেবেও। আর ক্ষমতাসীন রাজারা শুধু আসে যায়। কখনও রাজা হন আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কখনও বা হন ভাইপো রাজা। কখনও আবার আগাম স্বপ্ন দেখা বং-পদ্ম (?) ভাবি রাজা। যুগ যুগ জিও বেআইনি কয়লা। নগদ নারায়ন সম্ভবামি যুগে যুগে।

(www.theoffnews.com - coal mafia West Bengal CPM TMC BJP Congress)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours