সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

করোনার কোয়ারেন্টাইনের শত ভীতি উপেক্ষা করে অবশেষে বাজলো তোমার বেনুর মতো জাগলো নির্বাচনী রেনু যেন প্রত্যাশিত ভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে।

সবকিছু ঠিকঠাক চললে আর ছয় মাসও নেই রাজ্যের বিধানসভা ভোট যজ্ঞের।

গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে শাসক তৃণমূলের প্রায় ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে বিজেপি। যদিও ঘাসফুল শিবির প্রকাশ্যে চরম আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে দাবি করতে শুরু করে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দশ বছর থেকে পনেরো বছরের দিকে এগিয়ে চলবে মসৃণ গতিতে। কালিঘাট লেনের সাফ বক্তব্য, জনগন তাদের সঙ্গেই আছে। মা মাটি মানুষের এই সরকার বাংলার উন্নয়নের এক বিরলতম দৃষ্টান্ত। তাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আগামীদিনেও ক্ষমতায় তারাই থাকছে বলে তৃণমূলের দাবি।

তবে জোড়াফুলের এহেন গতানুগতিক রেকর্ড বাজানোর মতো নিয়ম করে প্রতিদিনের প্রেস ব্রিফের পাশাপাশি স্যোসাল মিডিয়াতে নানা পোস্ট ধামাকার চোরা স্রোত কিন্তু অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে। স্যোসাল মিডিয়ার একটা বড় অংশ জুড়ে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা বিরাট জনমত ট্রোল হচ্ছে প্রায় সুনামির ঢেউয়ের মতো অহরহ। আর জোয়ার গা ভাসিয়ে সমানে চলছে নানা লাইক থেকে রকমারি টিপ্পনি মার্কা কমেন্ট। কখনও বা তুঙ্গ বাকযুদ্ধ। 

পদ্মফুল শিবির এই স্যোসাল মিডিয়ায় তৃণমূলের এহেন নাস্তানাবুদ দ্বিচারি ব্যাটিং থেকে তোলা ফার্স্ট স্লিপের লোপ্পা ক্যাচ লুফে নিতে পেরে তো রীতিমত চাঙ্গা। একেতে সদ্য গত লোকসভা ভোটে ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি করায়ত্ব করতে পারায় বাংলার বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের বডি ল্যাংগুয়েজটাই রাতারাতি পাল্টে গেছে। ভাবখানা এমন যে আগামী বিধানসভা ভোটের পর রাজ্যপাল তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, আসুন আপনি সরকার গঠনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিন। বাংলা দখলের বিষয়ে দিলীপ ঘোষ এতটাই নিশ্চিত যে তিনিও পুরোনো ক্যাসেট অন করেই রেখেছেন, এবার আমরা দুশোর বেশি সিট জিতবো।

যদি একটু পিছিয়ে যাই আমরা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে কংগ্রেস জামানা দেখবো। সেদিনের বারোমাস্যার খুনজখম, পুরুষ বন্ধ্যাত্ব আর এমারজেন্সির কালা দিনগুলো বাংলার মানুষ আজও ভাবলে শিউরে ওঠেন। এরপর সিপিএমের রাজ্যত্ব দেখেছে রাজ্যবাসী জ্যোতি বসুর নেতৃত্ব। ভূমি সংস্কারের পটভূমি পাল্টালেও কল কারখানা জুড়ে চলত অবাধ কাজ নয় মাইনে বাড়াও নীতি। আর অপদার্থতা ঢাকতে 'কেন্দ্রের দোষ' আর মাতৃদুগ্ধের অনুকরণে ইংরেজি লোপাট করা শিক্ষাদান প্রেজেন্ট করা হল বঙ্গজীবনে। বোনাস হিসেবে শিল্পপতি পাকড়াও করতে বছরান্তে লন্ডন ভ্রমন তো জ্যোতি বসুর ক্যারিসমা। যা বাঙালি অত সহজে ভুলবে বলে মনে হয় না। অতঃপর বলতে দিদ্ধা নেই, সিপিএমের নতুন সেনাপতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অবশ্যই বাংলায় পুঁজি নিবেশে মনযোগী হয়েছিলেন আন্তরিক ভাবেই। তার ওই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের এক বিপুল সম্ভবনা তৈরি হতে শুরু করেছিল। কিন্তু ফেরো অ্যালয়ের ধোঁয়ার অসৌজন্যে বাংলার নীল আকাশে কালো কার্বনের আস্তরণ ক্রমেই জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। পাশাপাশি শিল্পের নামে গা জোয়ারি জমি দখল, নক্কারজনক ওরা আমরা বিভাজন, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম জেদাজেদি ইস্যু সিপিএমকে ব্যাকফুটেই পাঠিয়ে দেয় শেষমেশ জনতা জনার্দন।

বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণার সরকার দেখছে আমজনতা। রাজ্য জুড়ে আনাচে কানাচে সিভিল ওয়ার্ক আশাতীত ভাবে হয়েছে যা অতি বড় নিন্দুকও অস্বীকার করতে পারবেন না। তবে কাট্ মানি আর ট্রিপল ট্যাক্সের যা বহর চলছে সেটাও কিন্তু বিরল দৃষ্টান্ত। সঙ্গে ঝাঁপ বন্ধ কারখানা। বদলা নয় বদল চাই। স্লোগানটা কেমন যেন বদলে গেল। শাসক দলের বিরুদ্ধে কেউ ফোঁস করলেই বদলা গোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনী যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কষে টাইট দেওয়ার জন্য। কোনও দলের কাছে খাঁকি উর্দির এমন বশ্যতা বাংলা কি আগে এভাবে দেখেছে কিনা কে জানে। এর উপর আবার রাজ্য কোষাগার শূণ্য করে চলছে ভোট তোয়াজের দান অনুদানে ব্যক্তি মর্জি পর্ব।

এই বাংলা কংগ্রেসের সুদীর্ঘ জামানা দেখেছে পর্যায়ক্রমে। সিপিএমের সর্বহারার নমুনা ৩৪ বছরের। তাও বাঙালি ভোলেনি। তৃণমূলের দশ বছরের অনুপ্রেরণার বহর নিয়ে হাটে বাজারে চায়ের কাপে তো তুফান উঠেছে। তাই এবার স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপির বাংলা শাসন করার দাবি উঠতেই পারে জনমানসের দরবারে। তারাও বাংলা শাসনের একটা সুযোগ নায্যতঃ চাইতেই পারে। ভোটের রায় কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে তা যদিও বা এখানে বিবেচ্য নয়। কিন্তু এটুকু অবশ্যই বলা যায় বিজেপি বাদে বাংলার মসনদে বাকি সমস্ত দল আজ পরীক্ষিত। সেই কারণেই বিজেপির বাংলা শাসনের দাবি অনেকটাই বঙ্গবাসীর মধ্যে একটা নতুন আবেগ সৃষ্টি করেছে এটাও কিন্তু যথেষ্ট লক্ষনীয় ইদানিং কালে।

কিন্তু দিলীপ ঘোষবাবু এই অধুনা আবেগ দিয়ে প্রশাসন চালানো যায় না। সেটা জানেন কি? হ্যাঁ, মানুষের আবেগকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলের টেম্পারেচার বৃদ্ধি করা যায় কিন্তু রাজ্য পরিচালনা করা তা দিয়ে অসম্ভব। আর সেটা যে কত সত্যি তার নমুনা স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী নেত্রী হিসেবে উনি বাংলার অগ্নিমুখ কিন্তু বং প্রশাসক হিসেবেও তিনি যে সবচেয়ে সমালোচিত। তাই ক্ষমতার আসনে বসার স্বপ্নে সলতে পাকাতেই পারেন বাংলার পদ্ম সভাপতি কিন্তু এতে বাংলার আখেড়ে লাভটা কি? জনগন যদি আপনাকে তাদের ভোটটা দেন স্বাভাবিক ভাবেই তারাও কিন্তু যাচাই করে নিতে চাইবেন তাদের সামাজিক মুনাফা ও জীবন ধারণের সুরক্ষার বিষয়টি। সঙ্গে আর্থিক উন্নয়নের জন্য কর্মসংস্থান পরিকল্পনা ও শিল্পোন্নয়নের কর্মসূচী সংক্রান্ত ব্লুপ্রিন্ট আজ যে বাংলার মানুষ আপনাদের থেকেও জানতে চায়। ভোটের ঠিক মুখে একটা ইস্তাহারের চোতা বের করবেন সাংবাদিক সম্মেলনে-এতো সবাই বের করে রুটিং মেনে। ভোটের পরে সেই ইস্তাহারটা কাগজের ঠোঁঙা হয়ে যে বরাবর চলে যায় বিভিন্ন মুদিখানার দোকানে। আজ কিন্তু বাঙালি ভোটার অনেক সজাগ। তারা ঘর পোড়া গরু হলেও সিঁদুরে মেঘ দেখলে আর খুব একটা ভয় পায় না। তাঁরা আবার আকাট বোকাও নয়। দিলীপ ঘোষ সাহাব, আপনি যদি ভেবে থাকেন গো-দেবতার স্বর্ণ দুধ বিতরণ করে ভোট বৈতরণী পার হবেন তবে ভুল করছেন। মনে পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও কিন্তু দুধেল গাই ছিল। তবুও ১৮টি আসন তাকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয় আপনাদের। তাই স্বর্ণ দুধের সংখ্যাগুরু তোষণ আর দুধেল গাইয়ের সংখ্যালঘু তোষামোদের বস্তাপচা চর্চা বা পরনিন্দা বাদ দিয়ে ইতিবাচক একটা দিশা দিন বাংলাকে। আপনি তো বর্তমানে বাংলার বিরোধী নেতা। এই পশ্চিমবঙ্গের প্রতি আপনারও তো একটা দায়বদ্ধতা আছে। এদিকে অনবরত শুধুই আপনার গৈরিক শ্রীমুখ থেকে কুবচন নিঃসৃত হয়েই চলেছে। আবার মানুষের কাছে ভোট চেয়ে তো গলাও ফাটাছেন দিবারাত্র। কিন্তু বিনিময়ে আপনি কি দিচ্ছেন রাজ্যবাসীকে। তারা স্বর্ণ দুধের বদলে সু স্বাস্থ্যের স্বচ্ছ পরিকাঠামো চায়। কোথায় সেই আপনার ভাবনা? তারা শিল্প আশা করেন। কোথায় সেই কারখানা গঠন ও পুনরুজ্জীবনের রূপরেখা? তারা সামাজিক সুরক্ষা ও প্রকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা কামনা করেন। কোথায় আপনার সেই সব বাস্তবোচিত ভাবনা? অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের নূন্যতম সুব্যবস্থার জন্য তারা নির্ভরযোগ্য কর্মসংস্থানের জন্যে হাপিত্যেস করছে। কোথায় আপনার সেই সুপরিকল্পিত ভরসা-বাণী? ভোট চাইবার সঙ্গে সঙ্গে সদর্থক কিছু তো বলুন। নিশ্চয়ই সমালোচনা করুন কংগ্রেস সিপিএম ও তৃণমূলের। একইসঙ্গে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট নীতির একদম পেশাদার ইতিবাচক রূপরেখা প্রকাশ্যে ঘোষণা করুন অবিলম্বে। সাম্প্রতিক বাংলা পরিবর্তনের পরিবর্তন চায় না। তারা নেতিবাচক রাজনীতিতে বিরক্ত। এখানকার ভোটার কিন্তু খুব আশাবাদী এক নতুন পশ্চিমবঙ্গ দেখবেন বলে। তবে তাঁদের কাছেও একটা অদ্ভুত অপশন আছে। 'নোটা' বোতাম। তাই না বাংলার পদ্ম চুড়ামনি? দয়া করে এখনও ইতিবাচক হন। 

(www.theoffnews.com - politics West Bengal tmc cpim congress bjp)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours