শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

বানরকে মাছি তাড়াতে দিলে, বানর কোচের চাকু দিয়ে মনিবের নাক কেটে ফেলেছিলো। এমন গল্প আমরা শুনেছি, এখন দেখলাম। হেফজাতকে মাঠে এনে  জামায়াত তাড়াচ্ছে  আওয়ামী লীগ। সেই হেফাজত  বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নাক ভেঙ্গেছে! যা জামায়াতও করার সাহস পেতো কি না সন্দেহ। 

হেফাজতে 'ইসলাম' ও আওয়ামী লীগের বিরোধ অনিবার্য। এত তাড়াতাড়ি শুরু হবে তা অনুমান করতে পারিনি। শতভাগ পরস্পর বিরোধী দুই শক্তি এক ছাদের নিচে বেশি দিন  থাকতে পারে না। ইতিহাসে সে নজির নেই। 

বাংলাদেশে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়  ভাস্কর্য। কেউ বলছেন ভাস্কর্য মূর্তি নয়। কেউ বলছেন ভাস্কর্য ও মূর্তি একই শব্দ। এ বিষয়ে 'স্বঘোষিত' মৌলবাদী নেতারা কোরআন হাদিস থেকে তথ্য তুলে ধরছেন। আবার  আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোন কোন ব্যাক্তিও অভিধান খুলে বলছেন, ভাস্কর্য ও মূর্তি একই। কেউ বলছেন, না, এক নয়। কেউ বলছেন, মুর্তি হলেই বা ভাঙ্গতে হবে কেন? ভাস্কর্য ও মূর্তি এক, নাকি পৃথক, সে বিতর্কে আমি যাচ্ছি না। কেন না, ভাস্কর্য ও মূর্তি শব্দ দুটি এক ই অর্থ বহন করে কি না, তা আমি বাংলা ভাষা বিজ্ঞানীদের উপর ছেড়ে দিলাম। অবশ্য আমরা এও জানি ভাষা বিজ্ঞানীদের ভাষা ও মৌলবাদীদের ভাষা এক হবে না, হয়ও না। তা ভাস্কর্য শব্দটি মূর্তি হোক বা না হোক।

 মুফতি, আলেমদের এটাই সম্ভবত প্রধান সমস্যা, রাষ্ট্রকে তারা মসজিদের 'মিম্বর' এবং সকল নাগরিককে মাদরাসার 'তালেবে এলেম' মনে করেন। অবশ্য সকল মুফতি ও আলেম এমন ধারনা পোষন করেন না। ব্যতিক্রম আছেন কেউ কেউ। যারা সমঝদার আলেম তারা ভালো করেই জানেন, মসজিদ মাদরসার বাইরে প্রকৃতপক্ষেই তাদের রাজনৈতিক গ্রহন যোগ্যাতা নেই। আন্তর্জাতিক ভাবে কোন গ্রহন যোগ্যতা তো নেইই। বরং তাদের চরম "ধর্মান্ধ" ও "তালেবান" পন্থী মনে করা হয়। তাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক কার্যক্রম "ধর্ম সভার" ছদ্মবেশ নিয়েই চালাতে হয়। 

হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে 'স্বঘোষিত' মৌলবাদী নেতারা বিবাদে জড়ালেন কেন? তারা পাকিস্তান পন্থী নাকি তালেবান পন্থী প্রশ্ন থেকে যায়। এর আগে বিমানবন্দরের সামনে লালনের ভাস্কর্য নিয়ে, তারপর হাইকোর্টে সামনে থেমিসের ভাস্কর্য নিয়ে মৌলবাদীরা বিবাদে জড়িয়ে ছিলো। সরকার তাদের দাবি যে কারনেই তখন হোক মেনে নিয়েছে। তারা এবার  বুঝতেই পারেনি থেমিস, লালন এর ভাস্কর্য  আর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গা এক নয়!

তখন আওয়ামী জোটে যুক্ত জাসদ নেতা কমরেড মইন উদ্দিন খান বাদল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আজ আপনি ৭১ এর পরাজিত মৌলবাদী শক্তির দাবি মেনে নিলেন, এরা একদিন আপনার পিতার ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলবে। অদ্ভুত বিষয় কমরেড বাদলের মৃত্যূর বছর ঘুরতেই কথাটা সত্য হয়ে গেলো! বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দিতে চাইলো কট্টর মৌলবাদী এক নেতা। তার সাথে সুর মেলালেন আরো কয়েকজন 'তালেবান' সমর্থিত নেতা। তারা সকলেই 'ইসলামি" দলের নেতাও। তারা নিজেরাই পৃথক পৃথক দলের নেতা ইলোকশনেও অংশ নেন। আবার হেফাজতে ইসলাম (?) নামের একটি সংগঠনেরও নেতা। তাদের দাবি হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক(?) সংগঠন! যা ডাহা মিথ্যা। তারা যা করছেন তা সবই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। সাহস করে বলছেন না। যা করতে চান তা ভিন্ন পরিচয়ে করতে চান। এ জন্যই তাদের প্রতি সন্দেহ বাড়ে। কখনো কখনো তাদের 'হেফাজতে পাকিস্তান'  মনে হয়। কেন না, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের পূর্বসূরীদের প্রায় সকলের অবস্থান ভয়ংকর অথবা বিতর্কিত। আবার কেউ কেউ তাদের সরকারের তাবেদারও মনে করে। যদিও এমন সন্দেহ করা মানুষের সংখ্যা কম। হেফাজত  সরকারের তাবেদার হোক বা না হোক, তবে, তারা যা করছে তা বর্তমান সরকারের পক্ষেই চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন সমঝদার ডান বাম রাজনীতিকেরা। হেফাজতের বোঝা উচিত ছিলো, তার যতই 'পাকিস্তান পরস্ত' হোক এবং  ভেতরে ভেতরে শেখ মুজিবুর রহমান তথা বঙ্গবন্ধুকে যতই অপছন্দ করুক না কেন, বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে কোন কৌশলেই বুড়িগঙ্গা নাদীতে ছুঁড়ে ফেলতে পারবেন না। এমনকি তার ভাস্কর্যকেউ না। অনেকবার সে অপচেষ্টা করা হয়েছে। শেষে তাকে ৭৫ স্বপরিবারে হত্যাও করা হয়েছে। কিন্তু সকলেই ব্যর্থ হয়েছে। জীবিত শেখ মুজিব থেকে মৃত শেখ মুজিবের শক্তি কোন অংশেই কম নয়। বরং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংঙ্গতে গিয়ে, হেফাজত  সরকারের অনেক ভুল পদক্ষেপকে মাটি চাপা দেয়ার সুযোগ করে দিলো। নারগরিক ঐক্যের আনোয়ার হোসেন মুকুল, গণসংহতির আহ্বায়ক জোনায়েদ সাকি অন্তত তাই মনে করেন। 

এ বিষয়ে বিএনপির থিংক ট্যাংক গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরউল্ল্যা চৌধুরীর কথাটা বেশি প্রচার হচ্ছে, যে, হুজুরদের মাদরাসায় শিশু ধর্ষনের বিষয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত,  ভাস্কর্যের বিষয়ে নয়। টিভি টক শোতে জাতীয় পার্টি তথা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রবক্তা দলটির একজনকে বলতে শুনলাম, ভাস্কর্য বিষয়ে মৌলবীদের অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পরার কোন কারন ছিলো না। শামীম ওসমান এমপি তো বলেই দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু বিরুদ্ধে যে কেউ, যে কোন কৌশলে বিরোধীতা করলে, তারা কাউকে ছাড় দেবে না।

হেফাজতে ইসলাম, মূলত তারা ইসলামি আন্দোলন, খেলফতে মজলিস এরকম আরো রাজনৈতিক 'ইসলামি' দলের নেতা। তারা তাদের মার্কায় ভোট দিলে "জান্নাত' পাওয়া যাবে!  বা তাদের ভোট দিলে 'নবী' ভোট পাবেন। এসব কথায় 'শিরক' 'বেদাত' 'কুফরি' 'হারাম' খুঁজে পান না! 

আমাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে, বিএনপির কোটটাই পরা সবে "ধন নীল মনি" টাইপ এক এমপির টিভি সাক্ষাৎকার। যিনি সংসদে ভাষণ দিলে বুঝা মুশকিল তিনি জামায়াতের রোকন নাকি বিএনপি নেতা! তিনি হেফাজতের নেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন, তিনিও নাকি পবিত্র কোরআনের  তফসির মিলিয়ে দেখেছেন, "হুজুরেরা" যা বলেছেন তা সঠিক, ভাস্কর্য ও মুর্তি একই। এবং তা হারাম, নাজায়েজ। কিন্তু তিনিই আবার বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য জাদুঘরে রাখা যাবে। আমি বুঝলাম না, যদি হারামই হয় তা জাদুঘরে তিনি রাখতে বললেন কি ভাবে? এটাই বিএনপি সাংসদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। সোজ কথা হিপোক্রেসি বা ভন্ডামি যা এ উপমহাদেশের রাজনীতিকেরা বরাবরই করে থাকেন। আরো অদ্ভুত বিষয় হলো, ইসলামি শরীয়তে নারী নেতৃত্বও "হারাম" তা নিয়ে সেই বিএনপির সাংসদ কোন কথা বলেন নি বা তফসিরে খু্ঁজে পাননি৷ খুঁজে পাবেনও না ততদিন, যতদিন তারও দলের নেতা খালেদা জিয়া একজন নারী। আমি জানি না, সেই সাংসদ কোরআন ও তফসির খুলে প্রমান করতে পারবেন কি না, গনতন্ত্র "জায়েজ"! যদিও তিনি প্রতিদিন গনতন্ত্রের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। বৃটিশরা ধর্মের কার্ড খেলেছে৷ পাকিস্তান খেলেছে। আজ বাংলাদেশেও খেলছে, যে যার সুবিধা মত। পবিত্র ইসলাম ধর্মকে সুবিধাবাদীরা যে, যেভাবে পারছে ইলাস্টিকের মত টেনে তাদের কোমড়ে বাধার চেষ্টা করছেন। ফলাফল? উত্তর, ভয়াবহ। যেমন পাকিস্তান, সিরিয়া ও আফগানিস্তান। মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে কোন দেশ এগোতে পারেনি, পারবেও না। যদি সংঘর্ষ বাধে তবে দেশের অর্থনীতি ডুবে যাবে। যা কোন দেশ প্রেমিকের কাম্য হতে পারে না। 

কি করতে পারবে 'হেফাজতে ইসলাম'? তারা যা করতে পারবে তা আমরা দেখেছি, ৫ মে তে। বিএনপির মত বৃহত্তম দল ঘরকুনো ব্যাঙের মত চুপচাপ। জামায়াতের মত সংগঠিত শক্তি ঘর থেকে বের হতে পারে না৷ সেখানে হেফাজতের মত ভূঁইফোড় সংগঠন কি করতে পারবে! তাও আবার আওয়ামী লীগের মত তৃণমূলে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে  থাকা একটি প্রতিষ্ঠিত  রাজনৈতিক  সংগঠনের সাথে বিরোধ। বাংলা প্রবাদের বাক্যটাই মনে পরছে, 'মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত'! 

হেফাজতের ভাস্কর্য ভাঙার কর্মসূচীকে একটি জাতীয় দৈনিকে একজন লেখক ও কলামিস্ট "আস্পর্ধা" হিসেবে উল্লেখ্য করেছেন। আমি তা বলতে চাই না। আমি মনে করি এটা তাদের বোকামি। তারা বুঝতে অক্ষম যে, একটি দেশে অনেক চিন্তার, বিশ্বাসের, প্রথা ও মতের মানুষ বাস করে। রাষ্ট্র পরিচালনা আর ধর্মীয় উপাসনালয় পরিচালনা করা পদ্ধতি এক নয়। আপনি মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, পেগোডা, গুরুদুয়ারা ও সিনাগগের ডায়াসে দাঁড়িয়ে যা, বলতে পারবেন, তা প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের আসনে বসে বলতে পারবেন না।

দেশ চলে সংবিধান দিয়ে কোন ধর্মগ্রন্থ দিয়ে নয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের "কাফের" বলে মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিরত রাখা যায়নি। 'ইসলাম খতরে মে' বলে  পাকিস্তানের ভাঙ্গন ঠেকানো যায়নি। 

দেশের সমস্যা বেকারত্ব, দেশের সমস্যা দারিদ্র্য, কারিগরি শিক্ষার অভাব। এদেশের সমস্যা দূর্নীতি। এ দেশের সমস্যা আইনের সুশাসনের অভাব। সে দিকে দৃষ্টি দিলে জাতির উপকার হতো। চীন যখন কৃত্রিম চাঁদ বানায়, সূর্য বানায়, আমরা তখন ভাবছি, ভাস্কর্য মূর্তি কি না; জায়েজ নাকি হারাম! 

(www.theoffnews.com - statue broken Bangladesh Bangabandhu)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours