দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

কিছুদিন আগেই গেছে ইংরেজি মত অনুযায়ী তাঁর জন্মদিন। অথচ সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের এই 'গণ্ডীভাঙা মা'-এর অপার স্নেহময়ী রূপ শাশ্বত। সাক্ষাৎ ভুবনেশ্বরী বিশ্বজননীর চিন্ময়ী সত্ত্বার মানবী রূপে মহাপ্রকাশ। 

বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর একদা মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল এবং মল্লভূমি নামে পরিচিত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা বীরহাম্বিরের হাত ধরে এখানকার মানুষ ভেসেছিল বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ারে। বিষ্ণুপুরকে সাজানো হয় বৃন্দাবনের মতো করে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও তাই বিষ্ণুপুর বলতে গুপ্তবৃন্দাবনের কথা উল্লেখ করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীশ্রীমায়ের পুণ্য আবির্ভাব স্থান কামারপুকুর ও জয়রামবাটি থেকে বিষ্ণুপুরের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। ঠাকুর অবগত ছিলেন এই গুপ্তবৃন্দাবন বিষ্ণুপুরের রাজাদের বিষয়ে। ভক্তদের সেকথা উল্লেখও করেছেন তিনি। ঠাকুর গুপ্তবৃন্দাবন বিষ্ণুপুর এসেছিলেন একটি মামলার সাক্ষ্য দিতে। সেখানে ভাবে তিনি রাজাদের অধিষ্ঠাত্রীদেবী মা মৃন্ময়ীকে দর্শনও করেছিলেন। এছাড়া ঠাকুর মা সারদাকেও বলেছিলেন, ‘ওগো, বিষ্ণুপুর গুপ্তবৃন্দাবন, তুমি দেখো।’ মা উত্তরে বলেছিলেন, আমি মেয়েমানুষ কি করে দেখব? সর্বজ্ঞ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘নাগো দেখবে, দেখবে।’ ঠাকুরের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলল বিষ্ণুপুর হয়ে বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে চালু হবার পর। তখন মা জয়রামবাটি থেকে বিষ্ণুপুর আসতেন এবং বিষ্ণুপুরে ট্রেন ধরে কলকাতা যেতেন। ঠাকুরের ভবিষ্যদ্বাণী মা একবার স্মরণ করে বিষ্ণুপুরের লালবাঁধের পাড়ে সর্বমঙ্গলা মন্দিরের প্রাঙ্গণে বসে বলেছিলেন, ‘ঠাকুরের কথা আজ সত্য হল।’ মা জয়রামবাটি থেকে বিষ্ণুপুর গরুর গাড়িতে আসতেন, কখনও বা পালকিতে। মা বিষ্ণুপুরে প্রথম প্রথম বিশ্রাম নিতেন কৃষ্ণবাঁধ, পোকাবাঁধের পাড়ে। স্টেশনেও তিনি বসতেন এক কাঁঠাল গাছের নিচে। সে গাছ আজও বর্তমান বিষ্ণুপুর রেল স্টেশনে। পরবর্তীকালে মা বিষ্ণুপুরের গড়দরজা মহল্লার কাছে ভক্ত সুরেশ্বর সেনের বাড়িতে বিশ্রাম নিতেন। সুরেশ্বর সেন ছিলেন বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদ তথা ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দের পরম ভক্ত বশীশ্বর সেনের বড় ভাই। মা তাঁকে বলতেন দ্বিতীয় গিরিশ। 

মায়ের প্রতি কতটা ভক্তি ছিল তার উল্লেখ পাই যখন দেখি সুরেশ্বর গরুর গাড়ি থেকে গরু খুলে ছেড়ে দিচ্ছেন আর নিজে মায়ের গাড়ি টেনে ঘরে নিয়ে আসছেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন বন্ধুবর বিভূতিভূষণ ঘোষের সাহায্যে। পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম শিষ্য স্বামী সদানন্দ (গুপ্ত মহারাজ) ১৩১৫ সালে বিষ্ণুপুর এসে দুমাস এখানে ছিলেন। সে সময় তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি। মা ১৩১৮ সাল থেকে এঁদের বাড়িতে বিশ্রাম নিতেন। 

বিষ্ণুপুর যাবার সময় ঘটত সব মজার মজার ঘটনা। একবার (২৯ মে ১৯০৯) মা বিষ্ণুপুরের পথে। মায়ের সঙ্গে ভাইঝি রাধু, মাকু, যোগীন মা, এক ব্রহ্মচারী ও ভক্ত রয়েছেন। মোট চারটি গরুর গাড়ি। কোয়াল পাড়ায় বিকালে পৌঁছবার কথা। সেখানকার ভক্তরা অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু গরুর গাড়ি রাতে পৌঁছল। ভক্তরা মায়ের রাতের খাওয়ার কথা ভুলে গেলেন। পরিবর্তে বিকালের জল মিষ্টি দিলেন। সেখানে থাকার ইচ্ছে থাকলেও সবাই এবার রাতেই গরুর গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেন বিষ্ণুপুরের দিকে। পথে কোতুলপুরে এক দোকানে লুচি-মিষ্টি আহার সারেন। আর একবার (১৫ মাঘ ১৩২৫) মা আসছেন জয়রামবাটিতে বিষ্ণুপুর হয়ে। ছটি গরুর গাড়ি। জয়পুর এসে রান্নাবান্না হল। রান্নার শেষে ভাতের হাঁড়ি উনুন থেকে নামাবার সময় তা গেল ভেঙে। সবার মাথায় হাত। মা একটুও বিচলিত হলেন না। খড়ের নুড়ি দিয়ে ভাত আলাদা করে ঠাকুরের ফটো ব্যাগ থেকে বের করে ঠাকুরকে কাঠি দিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন, আজ এইরকমই মেপেছ শিগগির শিগগির গরম গরম দুটি খেয়ে নাও। ভক্তরা তা দেখে হাসতে লাগল। মা বললেন, যখন যেমন, তখন তেমন, নাও তোমরাও খেয়ে নাও।

আরেকবার মা বিষ্ণুপুর স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। এক অবাঙালি কুলি মাকে দেবী ভেবে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। সম্ভবত স্বপ্নে তিনি মাকে দেখে থাকবেন। স্টেশনে সাক্ষাৎ মাকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারী ১৯২০-তে মা বিষ্ণুপুর থেকে কলকাতার উদ্বোধনের পথে শেষবার গমন করেন। যাবার আগে দু’দিন সুরেশ্বর সেনের বাড়িতে ছিলেন। আজ বিষ্ণুপুর তাই শুধু গুপ্তবৃন্দাবন, মন্দিরের দেশ, মল্লরাজাদের রাজধানী, সঙ্গীতের পীঠস্থান এসব শিরোপাতেই নয়, গর্বিত ঠাকুর ও মায়ের পাদস্পর্শ লাভ করেও। আজও তাই বিষ্ণুপুরে পরম শ্রদ্ধায় স্মরিত হয় কল্যাণময়ী মায়ের করুণাস্পর্শ।

(www.theoffnews.com - Shree Shree Sarada ma)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours