মৌসুমী প্রামাণিক, লেখিকা, কলকাতা:
পুরাতনকে লহ নতুন করিয়া। অতঃপর!
এই সরকারের সমস্ত বিলই আদানি এবং আম্বানিগোষ্টীদের সুবিধা করে দেবার জন্য। তাই বিরোধিতা ও আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদে সামিল হতে হবে। তা শুধু কৃষক বিল নয়, সব ক্ষেত্রেই। তবে এই মুহূর্তে এমন কোন আন্দোলন মানবদরদী কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বেশীর ভাগ মানুষই তো নিজের স্বার্থের দিকটাই আগে দেখে। তাই সমাজের প্রতি কোনে কোনে আবছা অন্ধকার। সেই আঁধারেই মিশে থাকে অভাবী মানুষের কান্না আর আর্ত চিৎকার। আর সেই কান্না- চিৎকার আন্দোলনের কোলাহলে হারিয়ে যায় নিশ্চিতরূপে। কারণ আমরা নিজেদেরকে কৃষক, দলিত, সংখ্যালঘু, আদিবাসী ইত্যাদি নানান ভাগে ভাগ হতে দিয়েছি। তাতে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ হয়েছে, কিছু গোষ্ঠীর উপকার হয়েছে। কিন্তু তখনই আর একটি অবহেলিত, শোষিত অংশ দগদগে ঘায়ের মতো মাথাচাড়া দিয়েছে। এইভাবে একটি দেশে সামগ্রিক উন্নতি সাধিত হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
যে কোন আন্দোলনের আগে গোটা সমাজে প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে কিছু সাধারণ ধারনা অবশ্যই থাকা উচিৎ। এটা যেমন ঠিক যে কৃষক ফসল না ফলালে সমগ্র দেশের মানুষকে ভুখা মরতে হবে। তেমনি এটাও ঠিক যে সেই ফসল কেনার মতো অর্থের যোগানও সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকতে হবে। গ্রামাঞ্চলের এক বিশাল অংশের মানুষ যেহেতু চাষাবাদ করে থাকেন, তাই তাদের সব জিনিস বাজার থেকে না কিনলেও চলে। কিন্তু শহরের মানুষকে প্রতিটি কৃষিজাত দ্রব্য বাজার থেকে কিনতেই হয়। তাই তারা সেখান থেকেই কিনবে যেখান থেকে সস্তা পাবে।
কর্পোরেট বিপনী সংস্থা আসার আগে অবধি মনোপলি আড়তদার ও বড় কৃষকের হাতে ছিল। সেখানেও প্রতিযোগিতা ও প্রতক্ষ্য কর লাগু হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিদেশী কিংবা দেশী বিভিন্ন সংস্থা যদি সরাসরি কৃষকের থেকে ফসল কিনে মার্কেটিং করে তাহলে মধ্যবিত্ত ক্রেতার সুবিধা হবারই কথা।
কর্মসূত্রে দেখেছি যে হরিয়ানা, রাজস্থান ও পাঞ্জাবের কৃষকরা কি পরিমান ধনী, ঘরে ঘরে মার্সিডিজ, ফার্ম হাউস, সুইমিং পুল। অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর কিছু অংশে তো শুধুমাত্র ক্যাশ টাকায় ডিল হয়। মেয়েদের বিয়েতে ভরি ভরি সোনা যৌতুক দেওয়া হয়। তবে কৃষক মানেই গরীব সেই কথাটা আর সবক্ষেত্রে খাটছে কি? আর তা যদি না হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ তেমন আন্দোলনকে সমর্থন করবে কেন?
দরিদ্র কৃষক যে নেই তা নয়। কিন্তু ভতুর্কিযুক্ত চাল, টাকা ইত্যাদির দৌলতে অনেকেই করে কর্ম্মে খাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও কিছু কৃষক পরিবারে দেখেছি যে তাদের হাতে ক্যাশ টাকা উড়ছে। উপরন্তু প্রতি পরিবারে একজন করে সদস্যর সরকারী চাকরী। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে বিশেষত।
গরীব তো চাকুরীজীবিও আছে। গরীব তো শিক্ষিত বেকারেরাও। তবে তাদের জন্য আন্দোলন হবে না কেন?
সুতরাং কোথাও গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে শহর শহরতলী এবং গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে ইকনমিকালি এক বিশাল ফারাক তৈরী হয়েছে যা দেশের সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও অবস্থার পক্ষে সুখদায়ক নয়। উদাহরণ স্বরূপ আমার আত্মীয় কিছু পরিবার গ্রামে চাষাবাদ করেন। তাদের সদস্যরা অনায়াসে ২/৩০০০ টাকার পোষাক কিনতে পারে। আমাকে শহুরে পরিকাঠামোয় থেকে কিন্তু অসংখ্যবার ভাবতে হয়।
ভর্তুকি, ভাতা ইত্যাদি আজকের দিনে অচল। এর কারণেই রাজনৈতিক দলগুলি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকার যোগান না থাকলে ডিমাণ্ড ও সাপ্লাইয়ে ভারসাম্য আসবে না আর কোন আন্দোলন বা কোন সংস্কার মুখ থুবড়ে পড়বেই। এই মুহূর্তে তাই সহজ সমাধান খুঁজতে হবে। যেমন মার্কেট সবসময় ওপেন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সুসম প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরী করতে হবে। প্রত্যক্ষ কর যতো কম লাগু হবে ততোই পরোক্ষ করের বোঝা সকল শ্রেণীর মানুষের বোঝা বাড়াবে। এই বিষয়ে জন আন্দোলন সবার আগে প্রয়োজন। এগ্রিকালচারাল ইনকাম কিংবা ধর্মীয় সংস্থা একটা লিমিটেশানের পর সকলকেই ট্যাক্স দিতে হবে; এমনটাই নিয়ম হওয়া উচিৎ।
সমাজের প্রতি কোনে কোনে যদি এত অসামঞ্জস্য থাকে কোন আন্দোলন থেকেই সুফল পাওয়া কি সম্ভব? সবটাই তো শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্ট্যান্ট হয়ে রয়ে যাবে।
প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষকে আগে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কেন এমন অবস্থা হবে যে চাষীর ছেলে চাকরী না পেলে অবসন্নতায় ভুগবে। শিক্ষিত হয়েও চাষাবাদ করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বই আসতো বাড়িতে। পড়েছি ও দেশের লোকের মানসিকতা। মেয়েরাও ট্রাক্টর চালিয়ে চাষ করছে গর্বের সঙ্গে।
প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে এমনিতেই কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন কমতেই থাকবে। ব্যবসা ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান করতেই হবে। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টিচার, অফিসার ইত্যাদি হবার স্বপ্ন দেখানো হয় মানে সেই চাকরীর উপর নির্ভরশীলতা। অথচ কৃষক, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড় কিংবা লেখক হবার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় না। কারণ রোজগারের দিক থেকে এদের জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা।
তাই আন্দোলন যদি করতেই হয়, তবে নীচুতলা থেকে উপরতলা সমগ্র মানবজাতির মানসিকতা বদলের জন্য জীবনবোধের পরিবর্তনের জন্য লড়াই করার ডাক দেওয়া উচিৎ।
সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলির হাত থেকে নিজেদের আলাদা করার কথা ভাবতে হবে। কারণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনের ভার তাদেরই হাতে। এবং এই মুহূর্তে প্রতিটি দলই কর্পোরেট ব্রোকারশিপের ভূমিকায়। সমাজের সবস্তরে সুষম বন্টন বাধ্যতামূলক করতেই হবে। তা না হলে একদল পড়ে পড়ে মার খাবে আর এক দল নিথর হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখবে। আর জোর যার মূলুক তার এই দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে সুযোগ সন্ধানীরা হরির লুটের বাতাসা লুটে পুটে খাবে। তাই প্রতিটি আন্দোলনের ইতিবাচক অভিমুখ নিয়ে নতুন করে ভাববার দিন এসে গেছে। অবশেষে শুরু হোক নব সূর্যোদয়।
(www.theoffnews.com - agriculture agitation)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours