প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র, লেখক, কালনা, পূূর্ব বর্ধমান:

সব্জী রান্নায় যেমন নুন অপরিহার্য, তেমনি আমি মনে করি আমার জীবনে সুস্থভাবে বাঁচতে  ভ্রমনের গুরুত্ব অপরিহার্য। ভ্রমন আমায় বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। বছরে তিন চারবার ভ্রমন সুখ থেকে বঞ্চিত হলে আমি অন্তত বাঁচব না বলেই মনে করি। তাই পরিবার পরিজনরা বিরক্ত হলেও খুব একটা বাধা দেয় না কেউ। যাই হোক মহামারী আতঙ্ক, পৃথিবী ঘর বন্দি। আমাদের প্রজন্ম দীর্ঘ এমন লকডাউন জীবনে কোনদিন দেখিনি। ঘরে বসে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। কোথাও একটা না যেতে পারলে মনে হচ্ছিল না আর বাঁচব। মানসিক রোগগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম তাই করোনা পর্বেই একটু আনলকডাউন হতেই একাই বেরিয়ে পড়লাম দুই দিনের জন্য শান্তিনিকেতনের পথে। শান্তিনিকেতন মানেই রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত পথঘাট, প্রার্থনা গৃহ, বট বৃক্ষ, ছাতিম তলাই শুধু নয়, বরং এবারের শান্তিনিকেতন ভ্রমন পরিকল্পনায় আমি রাখলাম ইছাই ঘোষের দেউল, গড় জঙ্গলের শ্যামারূপা মন্দির ও সতীপিঠ কঙ্কালি তলা। করোনা পর্বে শান্তিনিকেতন খুব ভালো ঘুরে দেখতে পারব না জানতামই। এখনও কড়া নিরাপত্তা বলয়ে রবীন্দ্র স্মৃতি সৌধগুলি। তবুও তো বেরিয়ে পড়লে একটু মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করব, তাই বেরিয়ে পড়লাম অচেনা অজানা এই পথ ধরে। 

বর্ধমান স্টেশন থেকে সকাল ৯.১০ মিনিটের রামপুরহাট লোকালে চড়ে নির্দিষ্ট সময়ের একটু পর পরই পৌঁছালাম বোলপুর স্টেশনে। করোনা আবহে কম ট্রেন চলছে তাই ট্রেনে চড়ে ভিড় দেখে মনে হলো না আমরা মহামারীর আবহে আছি। তবে এ সময় ট্রেনে হকারের উপস্থিতি ভীষণ ভাবেই কম। বোলপুরেই থাকেন সন্তু মুখার্জি, সম্পর্কে আমার ভাই। তাই এই যাত্রায় হোটেল খোঁজার কোন প্রশ্ন নেই। ওর বাসাতেই রাত্রিবাসের পরিকল্পনা। 

ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের বাইরে যখন এলাম ততক্ষনে খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই সন্তু স্টেশনে হাজির হলো। ওর সাথে স্থানীয় একটি দোকানে লিটটি ও চা খেয়ে বাইকে যাত্রা শুরু করলাম অজয়ের তীরে অবস্থিত ইছাই ঘোষের দেউলের পথে। বোলপুর থেকে ইছাই ঘোষের দেউল মোটামুটি ৩২ কিমি পথ। শাল, সেগুন, ইউক্যালিপটাসের ঘন জঙ্গলের পথ চিড়ে এ পথের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। কংক্রিটের পথ ধরে কিছু দূর যাবার পরই পড়ল অজয়ের পাড় ধরে লালমাটির এবড়ো খেবরো মেঠো পথ। এখনও অজয়ের তীরে কাশফুল ফুটে রয়েছে ডিসেম্বর মাসে। হালকা শীতের আমেজ বেশ ভালো লাগছে। পথে চলতে চলতে একটি চায়ের দোকানে কিছুক্ষন চা পানের বিরতির মধ্যে স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসীর কাছে আক্ষেপের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ওনারা বললেন "প্রতি বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে শহর থেকে অনেকে পিকনিক করতে আসেন দেউলে। কিন্তু এ বছর কি আর  কেউ আসবেন?"

যাই হোক এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ইছাই ঘোষের দেউলের প্রাঙ্গনে। মধ্যযুগীয় ধর্মমঙ্গল কাব্যগ্রন্থে ইছাই ঘোষের বর্ননা আছে। মনসামঙ্গল বা চন্ডীমঙ্গল কাব্যের মত অত জনপ্রিয়তা না পেলেও ধর্মমঙ্গল কাব্যে রাঢ় অঞ্চলের সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূপ্রকৃতির খোঁজ পাওয়া যায়। সেই কারণে গবেষকদের কাছে ধর্মমঙ্গল কাব্যের ও ইছাই ঘোষের দেউলের আলাদা গুরুত্ব আছে। ইছাই ঘোষ ঐতিহাসিক চরিত্র ছিলেন কিনা, সেটা এখনও পরিষ্কার হয়নি, তবে, পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা থানা এলাকাতে এই পুরোনো মন্দিরটির গুরুত্ব বঙ্গবাসীদের নিকট অপরিসীম। স্থানীয় অঞ্চলে এই মন্দির ‘ইছাই ঘোষের দেউল’ নামে পরিচিত। মন্দির স্থাপত্যের একটা বিশেষ রীতিকে বলা হয় দেউল। এই ধরনের মন্দিরগুলো অনেকটা লম্বা উঠে গিয়ে ওপরের ছাদটা খিলানের মতো বেঁকে যায়। মন্দিরের ভিতর স্বল্প পরিসর জায়গায় একটি শিবলিঙ্গ আছে, এই লিঙ্গের নিত্য পূজাও হয়। জঙ্গল পরিবেষ্টিত এই দেউলের আশেপাশে আজও শহরের ছোয়া লাগেনি। এখানে একটি চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই পাবেন না। তাই দর্শনার্থীদের প্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে এখানে আসা উচিত। ১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দে এই দেউল গড়ে উঠেছিল অধুনা পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা জঙ্গলে। 

সুউচ্চ এই দেউলটির গঠনশৈলী দেখলে আজও তাক লেগে যায়, তবুও আমার মনে হয়েছে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আছে। 

দেউল দেখে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লাল মাটির পথ ধরে এরপর যাত্রা শুরু করলাম গড় জঙ্গলের শ্যামারূপা মন্দিরের উদ্দেশ্যে। কথিত আছে ইছাই ঘোষ শ্যামারূপা মায়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি শক্তির উপাসক ছিলেন। কথিত এই মন্দিরে আগে কাপালিকরা নরবলি দিতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি জয়দেবের এই মন্দিরে আগমনের পর নরবলি বন্ধ হয়। মন্দিরে প্রবেশের কিছুটা পূর্বেই নাগা সন্ন্যাসীদের একটি মন্দিরও আছে। সেটিও দেখে নেওয়া যায়। তবে আমাদের সময়ের অভাবে সে মন্দিরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে একটি কথা বলে রাখি এই পথ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে যে কেউ পথভ্রষ্ট হবেন। গল্প কথা তুর্কিরা একবার ইছাই ঘোষকে আক্রমন করতে এলে এ পথে তাঁদের নিয়ে এসে ইছাই ঘোষ তুর্কি নাচন দেখিয়ে ছেড়েছিলেন। অনেক তুর্কি সৈন্য নাকি পথভ্রষ্ট হয়ে খাদ্যের অভাবে এই জঙ্গলে প্রাণ হারিয়েছিলেন। যদিও ইতিহাসে এ গল্পের কোন সত্যতার প্রমান পাওয়া যায়নি। 

এই দুটি মন্দির দেখতে দেখতেই আমাদের প্রায় বিকাল ৩ টে বেজে গিয়েছিল। এদিকে ক্ষিদেও পেয়েছে, তাছাড়া সূর্যের আলো এই জঙ্গলে প্রবেশ না করার কারনে বেশ ঠাণ্ডাও লাগছিল। তাই ফিরে আসার জন্য রওনা দিই শান্তিনিকেতনের পথে। মাঝ রাস্তায় একটি ধাবায় দুপুরের আহার সেরে শাল, সেগুন, অর্জুনের জঙ্গলের বুক চিড়ে কংক্রিটের পথ ধরে রওনা দিলাম শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতন ফিরে দেখে নিলাম রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা গৃহ, প্রাচীন বট বৃক্ষ ও ছাতিম তলা। যদিও নিরাপত্তার কারণে দূর থেকেই এসব দেখতে হয়েছে। 

পরের দিন ঘুম ভাঙতে দেখি ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে আকাশ। কিছুটা দূরের বাড়িগুলিকেও দেখা যায় না। ভাবলাম মুক্তির স্বাদ যখন পেয়েছি একটু দেরি করে বিছানা ছাড়লেও ক্ষতি নেই। গতকাল বাইকে করে কত কত পথ ঘুরেছি, মনে হচ্ছে কোমড়ে যেন কেউ পাথর চাপিয়ে রেখেছে। আজ কঙ্কালি তলা সতী পিঠ ও সোনাঝুড়ি হাটে যেতে হবে। খুব বেশি দূর নয়। বোলপুর থেকে কঙ্কালি তলা ১২ কিমি পথ আর ফিরে এসে দুপুরে খাবার খেয়ে বিকালে সোনাঝুড়ি যাব বাইকে চড়ে। তাই  সকাল ১০ টায় প্রাতরাশ সেরে হেঁটেই পৌঁছালাম বোলপুর বাসস্ট্যান্ডে, চেপে বসলাম বাসে জানলার ধারে একটি জায়গা নিয়ে। তখনও মনে হচ্ছিল বোলপুর শহরের যেন ঠিকঠাক ঘুম ভাঙেনি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বাসের কন্ট্রাক্টর কঙ্কালি তলা বলে দুবার হাঁক দিল। বাস থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক হেঁটে পৌঁছালাম সতী পিঠ কঙ্কালি তলায়। খুব বড়সর মন্দির নয়। তবে প্রশস্ত জায়গার উপর মন্দিরটি নব নির্মিত বলেই মনে হলো। মন্দিরের পাশেই একটি ছোট্ট কুন্ড। কথিত আছে এই কুন্ডতেই সতী মায়ের অঙ্গ পড়েছিল। তাই কঙ্কালি তলা ৫১ পিঠের অন্যতম পিঠ। অনেক সাধু, সন্ন্যাসী, তান্ত্রিক, ভক্তরা দূরদূরান্ত থেকে এখানে আসেন মায়ের পূজা দিতে। আমার ও সৌভাগ্য যে আমি এই পিঠ দর্শন করতে পারলাম। কথিত আছে কঙ্কালি তলায় সতী মায়ের কাঁকাল অর্থাৎ কোমড় পড়েছিল। সতী দেহত্যাগ করার পর ভগবান মহাদেব যখন সতীকে কাঁধে নিয়ে ক্রোধান্বিত হয়ে ঘুরছেন তখনই বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের আঘাতে সতী মায়ের দেহ দেশের ৫১ টি স্থানে প্রোথিত হয়। সেই স্থানগুলি সতী পিঠ নামে পূজিত হয়। 

ভরতচন্দ্রের মতে -

"কাঞ্চি দেশে পড়িল কাঁকলি অভিরাম

বেদগর্ভা দেবতা ভৈরব রুরু নাম।"

কোপাই নদীর তীরে অবস্থিত কঙ্কালি তলা মহাপিঠ ও মহা শ্মশান সেই থেকেই যুগযুগ ধরে পুণ্য ভূমি। 

মার্কেন্ডেও পুরান মতে বোলপুরের (বলিপুরের) রাজা সুরথ দেবী চন্ডীর কৃপালাভ করেছিলেন এক লক্ষ বলি দান করে। সম্ভবত এই কঙ্কালি তলায় সেই স্থান। এখানে দেবীর দেহ শীলা রূপে মন্দিরের পাশের কুণ্ডে অবস্থান করছে। স্থানীয় জনৈক ব্যক্তি বললেন এই শিলাখন্ড ঠিক মানব দেহের কাঁকের মতোই দেখতে। প্রতি বারো বছর অন্তর এই শিলাখন্ড কুণ্ডের পাঁক তুলে জনসমক্ষে আনা হয়। সেই দিন এই শিলাখন্ড ভক্তদের দেখার সুযোগ হয়। এই কুণ্ডের জল স্পর্শ করা অত্যন্ত সৌভাগ্যের। আমিও এই জল স্পর্শ করলাম। 

এদিকে প্রায় দুপুর গড়িয়েছে। এবার আমায় ফিরতে হবে। তাই বাসে করেই বাড়ি ফিরলাম।  দুপুরের আহার সেরে বিকাল নাগাদ পৌঁছালাম বোলপুরের সোনাঝুড়ি হাটে। লকডাউন পর্ব থেকেই হাটে ভীড় কম ফলে বেচাকেনাও কম। শীতের মৃদু হাওয়ায় গাছের পাতার নাচন দেখতে দেখতেই পৌঁছালাম বাউলের আখড়ায়। তারপর কিছুক্ষন আদিবাসী বাদ্য ও নাচের তালে পা মিলিয়ে সন্ধ্যায় ফিরলাম বাড়ি। আজ রাতেই ব্যাগপত্র গোছগাছ করতে হবে। আগামী কাল সকালের ট্রেনেই যে ফিরতে হবে বাড়ি। 

পরের দিন সকাল ৮ টায় ট্রেনে চড়ে ভ্রমনের স্মৃতিমন্থন করতে করতে যখন ফিরছি তখনও শান্তিনিকেতন, ইছাই ঘোষের দেউলের নষ্টালজিক মূহুর্তগুলো স্বপ্নের মত ভেসে উঠছিল বারেবারে। এসব ভাবতে ভাবতেই  পৌঁছালাম বর্ধমান স্টেশন, তারপর আমার শহর কালনায়। 

শান্তিনিকেতনের শান্তি চিরস্মরণীয় হবে আমার স্মৃতির মণিকোঠায়। 

কি ভাবে যাবেন :- বর্ধমান বা হাওড়া স্টেশন থেকে রামপুরহাটগামী যে কোন ট্রেনে বোলপুর স্টেশনে নেমে এই জায়গাগুলো দেখে নেওয়া যায়। রাজ্যের বিভিন্ন শহর থেকে বাসেও যাওয়া যায়। 

থাকবেন কোথায় :-শান্তিনিকেতন অসংখ্য হোটেল ও রিসর্ট আছে।

(ছবি সৌজন্যে: প্রতিবেদক) 

(www.theoffnews.com - Shantiniketan Deul kankalitala)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours