দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

“ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে”- প্রবাদটি বহু কথিত, এবং বহুলভাবে প্রচলিত বাংলা সাহিত্যে। বাস্তবিক ঘুমন্ত শিশুর ফুলের মতো মুখের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করতে ভালো লাগে, সুদূর অনাগত ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল চিত্র। আজকের শিশু আগামী প্রজন্মের জনক- এক নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্ন তার মধ্যে রয়েছে। শিশুর মধ্যেই সুপ্ত থাকে ভবিষ্যৎ সমাজ, দেশের সার্থক কাণ্ডারির সুন্দর প্রতিচ্ছবি।

প্রদীপের ঠিক নীচেই অবস্থান করে অন্ধকার।

ব্যতিক্রম এই ক্ষেত্রেও হয়নি। 

ফুলের কুঁড়ির প্রতি দৃষ্টি রাখলে যেমন আগামী দিনের শতদল, নানাবর্ণের, সুগন্ধযুক্ত প্রস্ফূটিত ফুলের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, পাশাপাশি সেই নিষ্পাপ কুঁড়িটিকে নিয়ে পণ্যের বাজারে সওদা করা হচ্ছে, বলা ভালো নিজেদের নোংরা স্বার্থপূরণের জন্য টাকার জুতোর নীচে পিষে মারা হচ্ছে – এই পাশবিক দৃশ্য কল্পনাতে আনতেও অন্তরাত্মা প্রকৃত অর্থেই কেঁপে ওঠে, প্রশ্ন জাগে এও কি সম্ভব মানুষের ক্ষেত্রে? 

অনাহত উত্তর ইতিবাচক হয়ে আমাদের মনুষ্যত্ত্বকে নাড়া দিয়ে যায়।

হ্যাঁ। সম্ভব। বাস্তব যে সম্ভব-অসম্ভবের ধার ধারে না, তা আর একবার প্রমাণিত হয়ে যায়।

আর সম্ভব মানুষের পক্ষেই।

মানুষের পক্ষে নাকি কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু এত নিষ্ঠুর অসাধ্যসাধন যে মনুষ্যত্ত্বেরই লজ্জা।

কিন্তু মানুষ তাও করে দেখিয়েছিলো। 

এই একবিংশ শতাব্দীরই কোনও এক ২২শে নভেম্বর বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম-এ তদন্ত করে তিনটি পরিচয়বিহীন শিশুর উদ্ধার করা হয়। কিন্তু গল্পের এখানেই শেষ হয় না। বরং বিস্তৃত নাটকের পটভূমিকা রচিত হয়। ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে’- বেরোনোর মতই তিন সদ্যোজাতের উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে একটি গোটা শিশুপাচার চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ যার সঙ্গে উঠে আসে সমাজের তথাকথিত স্ব স্ব ক্ষেত্রে ‘প্রতিষ্ঠিত’ ব্যক্তিবর্গের নাম। তাদের কেউ প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক, কেউ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার- এছাড়াও জানতে পারা গেছে তাদের সঙ্গে জড়িত এমন অনেক ব্যক্তিবর্গের নাম যারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সমাজের নীচু তলার মানুষ। 

বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম থেকে সন্দেহের তীর ঘুরে যায় দক্ষিণ শহরতলির ঠাকুরপুকুরে ‘পূর্বাশা’- নামে মানসিক প্রতিবন্ধীদের একটি হোমে। সেখানকার দোতলার একটি ঘর থেকে দশটি শিশুকন্যা উদ্ধার হয় এবং অফিসাররা জানান, উদ্ধার হওয়ার সময় অধিকাংশ শিশুই এই ঠাণ্ডায় মাটিতে শোওয়ানো ছিল এবং কয়েকটি কাপড়ের দোলনায় রাখা ছিল। তার কয়েক ঘন্টার মধ্যে হাবড়ার মছলন্দপুরের ‘সুজিত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর পিছনের মাঠ খুঁড়ে দুই শিশুর দেহাবশেষ ও শিশুর ভ্রূণ পাওয়া যায়। সন্ধান মেলে বসিরহাটের আরও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নাম, মহাত্মা গান্ধী রোডের শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমের নাম এবং বেহালার সাউথ ভিউ নার্সিংহোমের নাম উঠে আসে। পলি দত্ত ওরফে উৎপলা ব্যাপারী, সত্যজিৎ রায়, রিনা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাসুদা বিবি-দের সাথে প্রবীণ চিকিৎসক সন্তোষকুমার সামন্ত-র মতো মানুষের চেহারায় অমানুষদের নাম সামনে আসে। শিশুদের নিয়ে লাভজনক ব্যবসার মূল কাণ্ডারি এরা বলে অভিযোগ।

কিন্তু পুলিশ, প্রশাসন, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে কাজটা সহজ ছিল না। এই ব্যবসা চলত ধুরন্ধর পথে, কূট বুদ্ধিকে আশ্রয় করে। 

প্রশ্ন ওঠে, শিশুপাচারের সাথে কন্যাভ্রূণ এল কি করে ?

জানা গেছে, বেআইনিভাবে গর্ভপাতের মতো নীচ কাজও হত পূর্বলিখিত নার্সিংহোমগুলিতে  শিশুপাচারের মতো নীচ কাজের সাথে সাথে। পাচারের ধকল সহ্য করতে না পেরে (অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা, বিভিন্ন জায়গায় টানাপোড়েনের জন্য, উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে) মৃত্যু মুখে পতিত হত হতভাগ্য শিশুরা। তাদের পুঁতে ফেলা হত মাঠের মধ্যে। 

কিন্তু শিশু সংগ্রহ করা হত কীভাবে? আর সম্পূর্ণ আইনি উপায় তাদের দত্তকই বা দেওয়া হত কীভাবে?

শিশুপাচার চক্রে বিভিন্ন নার্সিংহোম ও হাসপাতাল জড়িত ছিল, এ তথ্য আমরা আগেই পেয়েছি। সেইসব হাসপাতালে দরিদ্র প্রসূতিদের সন্তানকে মৃত বলে আড়ালে সরিয়ে ফেলা হত। পরে তার জায়গায় অন্য কোন মহিলাকে (প্রসূতি নয়) টাকা দিয়ে ভর্তি করানো হত। ওই মহিলাকে ‘সুস্থ’ বলে কাগজপত্র তৈরি হত। একই সাথে নার্সিংহোমের চিকিৎসকরা নিঃসন্তান দম্পত্তিদের সন্তান দত্তকের প্রস্তাব দিতেন এবং ওই মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ করানো হত। তিনি আদালতে গিয়ে আইন মোতাবেক জনৈক দম্পত্তিকে শিশু দত্তক দিতেন। গোটা প্রক্রিয়াটির ওপর সরকারী শিলমোহর পড়ে যেত এবং এই সওদার জন্য ক্রেতাকে দিতে হত ৬-৭ লক্ষ টাকা। সরকারি অনুমোদিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধীনে থাকা হোমে, প্রথমে শিশুদের চুরি করে আনা ও তারপর দত্তক দেওয়া হত।

উদ্বার হওয়া শিশুদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে দেখা গেছে, বয়সের তুলনায় তাদের বৃদ্ধি বেশী। মুরগির ছানাদের মত কৃত্রিম উপায় ওষুধ, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি ঘটানো হত এবং তার জন্য সময় লাগত ৭-৮ মাস। যদিও অপুষ্টির স্বীকার তারা। 

গোটা বিষয়টি জনসমক্ষে আসার পর মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য, নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন, সরকারী উচ্চমহল, সংবাদমাধ্যম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বা বলা ভালো ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে ঘটা প্রথম ঘটনা নয়, নয় কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনাও। নারী পাচার, শিশুপাচার আগেও ঘটেছে। এই ঘটনাগুলি আমাদের ভাবতে বাধ্য করায়, আমাদের রোজকার নিশ্চিন্ত নিয়মের ছকে বাঁধা জগতের নীচে রয়েছে অন্য এক জগৎ। আলো আর অন্ধকারের মতোই পাশাপাশি সহাবস্থান করে তারা। মানবিক মূল্যবোধ যেখানে প্রবেশের ছাড়পত্র পায় না। সেখানে রাজত্ব করে আদিম জিঘাংসা, লালসা। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন বিস্ফোরণের মত সেখানকার ঘটনা আমাদের সামনে আসে। চায়ের কাপের নিশ্চিন্ত চুমুক কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। নড়েচড়ে বসি আমরা, ছি ছি-কার করি। তারপর ‘ব্যস্ত’ জীবনের তাগিদে আবার ভুলে যাই। একবারের জন্যেও কি নিজেদের ঘরের দিকে তাকিয়ে আমরা ভাবি, এই ঘটনা আমাদের সঙ্গেও ঘটতে পারে? শুধু নিজেদের পরিবারটুকু না, এই বৃহত্তর সমাজের প্রতি সামান্য দায়বদ্ধতাটুকুও কি এইসব ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হতে বলে না? শেখায় না আত্ম-সচেতন হতে? মনুষ্যত্বের এই অবমাননা কি গোটা মনুষ্য সমাজের মূল্যবোধের ভিত্তির দিকেই প্রশ্ন তোলে না? 

এরপরও সভ্য বলি নিজেদের। কিন্তু কবি শ্রীজাতের ভাষায় মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে

“উঁচু একটা টিলা খুঁজে দাঁড়াও আবার,

নীচে শেষ দেখতে পাবে এই সভ্যতার।”

(www.theoffnews.com - child)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours