ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:
অনলাইন শিক্ষার ধারণাটি অতি প্রাচীন না হলেও অতি সাম্প্রতিকও নয়। ২০০০ সালের প্রথম দশক থেকেই যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণে পৃথিবী আজ আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয় বন্দী। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার আলোয় বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে জাতিকে তৈরি করতে করোনা কালে চালু হয়েছে অনলাইন শিক্ষাদান। সারা পৃথিবী এখন আকস্মিক মহামারির কবলে। যার কারণে বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখতে আক্রান্ত দেশগুলিতে চালু করেছে অনলাইন ক্লাস পদ্ধতি।
অবশ্য জাতিসংঘের শিশু তহবিল, ইউনিসেফ বলেছে বিশ্বে স্কুলে পড়ছে এমন ছেলেমেয়েদের এক তৃতীয়াংশই অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণে অপারগ। সংস্থাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় দেড়শো কোটি শিশু প্রত্যক্ষ শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীও কাছে নেই টেলিভিশন, রেডিও, বৈদ্যুতিক কিংবা ইন্টারনেট সুবিধা। ইউনিসেফের প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনার কারণে দীর্ঘস্থায়ী লকডাউন প্রভাব ফেলেছে প্রায় দেড় বিলিয়ন শিক্ষার্থীর উপর। সামর্থ্য অনুযায়ী যারা পারছে তারা এই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারলেও শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে চলে গেছে অনেক শিক্ষার্থী। সাহারা মরুভুমির দক্ষিনের আফ্রিকা অঞ্চলে ৪৯ শতাংশ শিশুই অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি থেকে বঞ্চিত। এই সংখ্যা পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় ৪৮ শতাংশ, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ৪০ শতাংশ। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল মিলিয়ে ২০ কোটি শিক্ষার্থী শ্রেনী কক্ষের বাইরে থেকে কোনো রকম শিক্ষা গ্রহণে সমর্থ নয়।
দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের কারণে দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী শিশুরা মূলত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দরিদ্রতর পরিবারগুলো থেকে আসা শতকরা ৭২ শতাংশের বেশি স্কুলগামী শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষার জগতে প্রবেশ করতে পারছে না। এছাড়া উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর দরিদ্র পরিবারগুলোর ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে শিক্ষা গ্রহন করতে অক্ষম। যার পরিমান বিশ্বব্যাপী স্কুলগামী শিক্ষার্থীও এক তৃতীয়াংশ।
বয়স ভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক বয়সের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা গ্রহন করছে না। যাদের সংখ্যা প্রায় ১২০ মিলিয়ন। ছোট বাচ্চাদের জন্য অনলাইন ক্লাস সত্যি খুব চ্যালেঞ্জের বিষয়। এছাড়াও রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। যেমন অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রোগ্রামের অভাব, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ডিভাইসের অভাব, ক্লাস করার চেয়ে গেমস বা চ্যাটিং করতে বেশি আগ্রহী, মোবাইলের ছোট মনিটরে মনোযোগ কম।
প্রযুক্তির আশীর্বাদে বাংলাদেশেও প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে অনলাইন ক্লাশের মাধ্যমে। বাংলাদেশে জাতীয় সম্প্রচার বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে এই কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বিনামুল্যে শিক্ষাগ্রহণ করতো। কখনো বা তাদের শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য বিনামুল্যে পাঠ্যবই এবং টিফিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। করোনার কারণে অনেক অভিভাবক কাজ হারিয়েছে। তাদের পেটের খাবার যোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। সেখানে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের কথা চিন্তা করা কতোটা যুক্তিযুক্ত! এরপর আসি জাতীয় সম্প্রচারে প্রচারিত শিক্ষা পদ্ধতি। বাংলাদেশের সব এলাকা থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশন দেখা যায় না। যদিওবা দেখা যায়, সেখানে অবশ্যই সকলের ঘরে ঘরে টেলিভিশন থাকতে হবে।
ঢাকা শহরে রয়েছে অনেক ছিন্নমুল বা পথশিশু শিক্ষা কার্যক্রম। রাস্তায় বা বস্তিতে বেড়ে ওঠা শিশুদের অনেক এনজিও এবং সেচ্ছাসেবীরা স্কুল পরিচালনা করে। মাথার উপর যাদের ছাদ নেই এ সব শিশুদের কাছে অনলাইন শিক্ষা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ফলে দীর্ঘদিন শিক্ষাহীনতা তাদের মধ্যে হাতাশার জন্ম দিচ্ছে। ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ। এরই ধারাবাহিকতায় অধিকাংশ দরিদ্রশ্রেনীর পরিবার তাদের শিশুদের পুরোপুরি কাজে নিয়োজিত করে দিচ্ছেন। মাধ্যমিক পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। ছেলে শিক্ষার্থীদের স্থায়ীভাবে কাজে যোগদান করানো হচ্ছে। ফলে অনেক শিশু ঝরে পড়ছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা বাদ দিয়ে পরিবারের হাল ধরতে চাকরিতে যোগদান করছে। ফলে শিক্ষার ধারাবাহিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া ‘শিক্ষা না জীবন’ এই প্রশ্নটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সবার সামনে আসছে। ইতিহাসের পাতা হাতড়ালে আমরা দেখতে পাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সময় দীর্ঘদিনের জন্য বহুদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি স্থবির ছিলো। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও দীর্ঘদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এখানে জীবনটাই মুখ্য ছিলো, শিক্ষা নয়। বর্তমান সময়ে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোগত পরিষেবার অবস্থা মোটেই স্বাস্থ্যবান্ধব নয়। আবাসিক হল সমুহের সিট বন্টন ব্যবস্থা, হলের ডাইনিং-ক্যান্টিনের পরিস্থিতি মোটেই করোনা মোকাবেলায় বর্ণিত স্বাস্থ্যবিধি সমতুল্য নয়। হল সমুহে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখাটা অসম্ভব প্রায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আমরা জীবনটাকেই বহুলাংশে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি। বিপণি বিতানে, গণপরিবহনে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পারিনি। যার ফলে প্রতিনিয়ত করোনা সংক্রমন বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও নিহতের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলছে। এমনই এক সংকটময় পরিস্থিতিকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
(www.theoffnews.com - online class corona Bangladesh)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours