পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

২০০৮ সালের কথা, পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম দুর্গ দুই চব্বিশ পরগনায় চমকপ্রদ ফল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দক্ষিন ২৪ পরগনা তৃণমুলের দখলে গিয়েছে, উত্তরেও বামেদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতিতে বামেদের চেয়ে বেশি আসন এবং জেলা পরিষদে ১৬টি আসন। স্বাভাবিক ভাবেই এই ফলাফলে রীতিমত উল্লসিত এবং উত্তেজিত উত্তর ২৪ পরগণার তৃণমূল নেতৃত্ব এবং কর্মীরা। অনেকেই বলতে শুরু করে দিয়েছেন বামেদের শেষের শুরু এখান থেকেই স্পষ্ট। এই ফল প্রকাশের পর দিন, বারাসত স্টেডিয়ামে একটি অনুষ্ঠানের পরে আমরা দু চার জন সাংবাদিক আড্ডা মারছি। এমন সময় বালুদার ফোন। বালুদা অর্থাৎ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী) তখন গাইঘাটার বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূলের নেতা। সেই সময় বালুদা মাঝে মধ্যেই আমাদের জেলা অফিস তথা আমার বাড়িতে আসতেন। কোথায় আছি জেনে বালুদা হাজির স্টেডিয়ামে। স্বাভাবিক ভাবেই পঞ্চায়েতে তৃণমূলের ভাল ফলের প্রসঙ্গ উঠল। আমার স্পষ্ট মনে আছে “বর্তমান” কাগজের সাংবাদিক দেবদাস অধিকারী কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- “বালু তোমাদের দায়িত্ব কিন্তু বেড়ে গেল, সিপিএমের এত অত্যাচার, দুর্নীতির প্রতিবাদে মানুষ ভোট দিয়েছে, এর পরে ক্ষমতায় এসে কিন্তু এর মর্যাদা দিও”। স্বাভাবিক ভাবেই বালুদা দেবদাসদার কথায় সজোরে সায় দিয়েছিল। 

এই গল্পটা বললাম এই কারনে, বামদের প্রতি বিতৃষ্ণায় সাধারণ মানুষ যে দায়িত্ব তৃণমূলের কাঁধে তুলে দিয়েছিল তার কতটুকু মর্যাদা তৃণমূল দিতে পেরেছে আজ তা প্রধান আলোচ্য বিষয় সর্বস্তরে। বহুমুখী কাজে যুক্ত থাকার সূত্রে আমাকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতেই ঘুরতে হয়। বড় শহর, মফঃস্বলের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামেও যাই প্রায়শই। সাধারণ মানুষের মনে কিন্তু সরকার বিরোধী ক্ষোভ রীতিমত দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তার একটা বড় কারন নিচুতলার কর্মী বা নেতাদের লোভ এবং অত্যাচার। একই কারনে বাম, মূলত সিপিএমের প্রতিও বিতশ্রদ্ধ হয়েছিল সাধারণ মানুষ। তারই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে এখনও। এরই ফায়দা তুলতে তৎপর বিজেপি। না, গ্রামের মানুষ বিজেপিকে খুব ভালবাসেন এমনটা কোথাও মনে হয়নি। বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়া, কিংবা নদীয়া থেকে মুর্শিদাবাদ, সেখানেই গিয়েছি বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি স্থানীয় শাসক দলের নেতাদের ব্যবহারে (পড়ুন অত্যাচারে) তিতিবিরক্ত তারা বিকল্প চাইছেন। কিন্তু হাতের সামনে তেমন কোনও সুস্থ বা সুষ্ঠু বিকল্প না থাকায় আপাতত খড় কুটোর মত বিজেপিকেই আঁকড়ে ধরছেন অনেকে। এতে বিজেপির প্রতি প্রেম যতটা, তার কয়েকশো গুণ বেশি ক্ষোভ শাসকদলের প্রতি। সাংবাদিক হিসেবে এমনটাই দেখেছিলাম ২০১০-১১ সালে। 

পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করায়। কেউ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে কেউ বা অন্য দলের ইন্ধনে এই বিদ্রোহের একটা আবহ তৈরি করেছেন তাতে সাধারণ মানুষ আরও বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। ভোটের আগে এই ধরণের নাটক দেখে বাংলার মানুষ অভ্যস্ত, তাই তাদের কাছে এগুলি এখন বিরক্তির কারন। দুর্নীতি বা কাজ করতে না দেওয়ার অজুহাতে দল ছাড়লেও কোনও রাজনৈতিক নেতাই রাজনীতি ছেড়ে দেন না। শুধু রঙ বদলান। বাংলার মানুষ দেরিতে হলেও শাসনের রঙ বদলাতে পেরেছেন, কিন্তু তাতে লাভের লাভ যে খুব একটা হয় না তা তারা সম্যক বুঝে গিয়েছেন। পরিযায়ী কিছু রাজনৈতিক নেতা যারা ক্ষমতায় থাকতে দল বদলে বা ডাল বদলে চলেন তারাই আজ দলভারি। তাই কোনও রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কিছু আশা করাটাই এখন বুদ্ধিহীনতার পরিচয়।  

অসংখ্য মানুষকে দেখছি হতাশায় ভুগছেন। অর্থাৎ যে আশা, ভালবাসা নিয়ে তারা তৃণমূলকে এনেছিলেন তা এখন তলানিতে। এদিকে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের একের পর এক জনবিরোধী কার্যকলাপ দেখে শঙ্কিত, বিরক্ত। কিন্তু বাংলাতেও এখন তৃণমূলের বিকল্প বিজেপিই। কংগ্রেস বা বামেদের অবস্থা বাড়ির নবতিপর বয়োজ্যেষ্ঠর মত। তারা গুনতিতে আছে ঠিকই কিন্তু কোনও কাজে কম্মে তাদের ভুমিকা এখন নেই বললেই চলে। তাই পরিবর্তনের পর আবার পরিবর্তন হলেও তা যে মোটেই কোনও পরিবর্তন আনবে না তা নিয়ে স্পষ্টই প্রত্যয়ী সিংহভাগ মানুষ। বিরোধী থাকার অনেক সুবিধা আছে, তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে তৃণমূল। ক্ষমতায় এসে নিচুতলার কর্মীদের বেঁধে রাখার মত দলীয় পরিকাঠামো তাদের নেই। একজন মানুষের ভয় দেখিয়ে, একজন মানুষকে ভগবান বানিয়ে, একজন মানুষকে তোষামোদ করে একটি ধর্মীয় আখড়া বানানো সহজ। কিন্তু রাজনৈতিক দল চালানো বেশ কঠিন। বিজেপিতেও অনেকটাই তেমন নিয়মই চলছে। তাই তাদের কাছ থেকেও নতুন কিছু আশা করা বাতুলতা। শুধু অপেক্ষা এবং দেখার, খারাপ থেকে আরও কতটা খারাপ হতে পারে আমাদের অবস্থা। একই সঙ্গে কতটা সহ্যশীল হতে পারি আমরা।

(www.theoffnews.com - West Bengal politics CPM BJP TMC Congress)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours