রিঙ্কি সামন্ত, লেখিকা, কলকাতা:

‘উত্তরীয় লুটায় আমার/ ধানের খেতে হিমেল হাওয়ায়।/ আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে/ নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়।/ ভাঁড়ির শীর্ণা নদীর কূলে/ আমার রবি-ফসল দুলে,/ নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর/ চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায়।'

-নজরুল ইসলাম।

বঙ্গে ঋতুচক্রের পরিক্রমায় উত্তরের হিমেল বাতাস আর ভোরের কুয়াশা জানান দেয় হেমন্ত প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে। কবির উপমায়, এই ঋতু যেন মমতাময়ী নারীর সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতাকে বর্ণনা করে। হেমন্ত লক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টিতে ধরাধামে কৃষকের গোলা ভরে যায় নতুন ধানে।

কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের সমন্বয়ে হেমন্তকাল। বর্ষার শেষ দিকে বোনা ধান কার্তিকে পরিপক্ব হয় এবং অগ্রহায়ণ এর শুরুতে সেই ধান কেটে মড়াই করে গোলায় তুলে রাখে কৃষকেরা।

'অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মরসুম’। সম্রাট আকবর অগ্রহায়ণ মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা করেছিলেন।

ফসল তোলার পরই বাংলার ঘরে ঘরে পালন করা হয় 'নবান্ন'। নতুন চালের পায়েস, পিঠে-পুলি প্রভৃতি খাওয়ার পার্বনবিশেষ।

হেমন্তের খানিকটা দুর্নাম আছে শুরুর দিকের অভাব–অনটনের জন্য অবশ্যি হেমন্তের শেষ অংশ সমৃদ্ধির। আবহমানকাল থেকেই অগ্রহায়ণ মানেই কৃষকের মুখে অনাবিল হাসি, পরিতৃপ্তির ব্যস্ততা। 

এমনকি ধান কাটার পর ঝাড়াই মাড়াই করে চিটে সহ ধান ঘরে তোলার পর মাঠে পড়ে থাকা ধানগাছের সমগ্র অবশিষ্টই খড় বহুবিধ ব্যবহারের উপযোগী। গবাদি পশুর খাবার ও শয্যাপকরণ থেকে শুরু করে ঘর ছাউনি, জাজিম ইত্যাদি তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান। জৈবজ্বালানি হিসাবেও খড়ের ব্যবহার উল্লেখ যোগ্য। এই প্রসঙ্গে এক গল্প বলি, 

'ডাক্তার  কালীচরণ লাহিড়ী  ছিলেন কৃষ্ণনগরের সে যুগের ধন্বন্তরি কিন্তু রোগীদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন 'খড়ের ডাক্তার' নামে। 

কালীচরণ পালকিতে চেপে রোগী-বাড়ির তালিকায় টিক দিতে দিতে এক এক দিন এক এক দিকে চলে যেতেন - শান্তিপুর, ফুলিয়া,  নবদ্বীপ। রোগী দেখে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে তিনি ক্রমাগত এগিয়ে যেতেন। 

রোগীর বাড়ির লোকজন ওষুধ নিতে একের পর এক আসত গোয়াড়ী কৃষ্ণনগরে ওনার ঔষধাগারে। 

প্রেসক্রিপশন আবার দু ধরনের- মাথায় ঢেড়া চিহ্ন দেওয়া থাকলে কম্পাউন্ডার বুঝে নিতেন - রোগী গরীব, ওষুধের দাম নেওয়া চলবে না।  সেটা দাতব্য চিকিৎসার নথিতে যাবে।

একদিন কম্পাউন্ডারের হাতে এল একটা ঢেড়া চিহ্ন দেওয়া প্রেসক্রিপশন - মাত্র ছয়টি বাংলা অক্ষর তাতে লেখা। কম্পাউন্ডার নানাভাবে ভালো করে দেখলেন, কিন্তু ওষুধের নামটা বুঝতে পারলেন না।

তাঁর পরিচিত নাম নয়। বাধ্য হয়ে ডাক্তারবাবুর জন্য অপেক্ষা করতে হলো।

গ্রাম্য চাষীটি বিরক্ত হল, এ কী কম্পাউন্ডার,  নিজের ডাক্তারের হাতের লেখা পড়তে পারে না! তার কি এখন বসে থাকার সময় আছে? চাষের কাজ পড়ে রয়েছে। যাইহোক, অপেক্ষা করতেই হবে ভেবে বিরক্তি চেপে সে বসেই থাকল। যথারীতি সন্ধ্যা লগ্নে পালকি চেপে ফিরে এলেন কালীচরণ। চাষীটিকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন -'কিরে তুই এখনও বসে?

"কী করব, ডাক্তার বাবু? আপনের কম্পান্ডার তো ওষুধের নামই পড়তি পারছে না!"

কম্পাউন্ডার তাড়াতাড়ি প্রেসক্রিপশনটি বাড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করলেন - এটা আপনি কী লিখেছেন, ডাক্তার বাবু?  

- কেন ? বাংলাতেই তো লিখেছি। পড়তে পারলে না? এক গাড়ি খড়।

কম্পাউন্ডার হাঁ, চাষীটিও অবাক। সে তার বাবার জন্য ওষুধ নিতে এসেছে, খড় নিয়ে কী হবে? 

"শোন, ওর বাপের নিউমোনিয়া হয়েছে। গিয়ে দেখলাম রোগীর ঘরের ছাদ দিয়ে অঝোরে বৃষ্টির জল পড়ছে। ওষুধ দিয়ে কী হবে? আগে ছাদটা মেরামত করতে হবে। তাই এক গাড়ি খড় ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দাও। খরচটা আমার খাতে লিখে রাখ।"

এই সময় ন্যাপথলিনের গন্ধে মুড়ে চাদর, সোয়েটার, কম্বল আস্তানা ছেড়ে বেরোয়। আলু হাফ সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলেও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে সবুজ করাইশুঁটি, ধবধবে ফুলকপি, শীষ পালং, সিম ,মূলো কতকিছু।

করোনার দাপটে পাল্টে গেছে জীবনধারা। স্কুল, কলেজে যাওয়ার ভীষণ তাড়া নেই। সবকিছুই অনলাইনে। গরম ঠান্ডায় সর্দিকাশি বাড়ছে।বাড়ছে ভয়ও একঘরে হবার।

রিক্ততার মধ্যে সৌন্দর্য্য, ত্যাগের মধ্যে মুক্তির আস্বাদন এই বৈরাগ্যর ছবি লুকিয়ে আছে হেমন্ত ঋতুর মধ্যে। পরদুঃখ হরনেচ্ছায় শান্তির পরশ লাগুক কৃষকের জীবনে।

অগ্রহায়ণে পায়েশের শুভ্রতায় প্রাণ ফিরে পায় জীর্ণতা। নবান্নের সুঘ্রানে ভরে উঠুক সকলের জীবন। সর্ষেফুলের হলুদ গালিচায় মোড়া প্রকৃতি সেজে ওঠে নব সাজে।

(www.theoffnews.com - hemanta season West Bengal)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours