শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

খৃষ্টান শব্দটি বুঝে উঠার আগেই খৃষ্টাব্দ শব্দটি জেনেছি। বর্ষ বা সনের আগে শব্দটির ব্যবহার দেখে। তখন জানাতাম না খৃষ্টাব্দ শব্দটির সাথে খৃষ্টান ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সম্পর্ক রয়েছে। সে বয়স তখন হয়নি। আজ 'বড়দিন'। খৃষ্টধর্মের বৃহৎ বাৎসরিক ধর্মীয় উৎসব। খৃষ্ট্রীয় সম্প্রদায় এই দিনকে যীশুখৃস্টের জন্ম দিন হিসেবে মনে করে থাকেন। তবে প্রকৃতপক্ষেই ২৫ ডিসেম্বর বছরের অন্যন্য দিন থেকে বড়। ক্রিসমাস এর বাংলা অনুবাদ কিভাবে বড়দিন হয়, তা বাংলা ভাষাবিদেরাই বলতে পারবেন। 

মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করায় খৃষ্টানদের 'বড়দিন' উৎসব কি তা জানার বোঝার সুযোগ ছিলো না। এমন কি সামাজিক ভাবেও না। কেন না, কিশোর বয়সে আমাদের এলাকায় কোন চার্চ বা গীর্জা দেখিনি। খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষও ছিল হাতে গোনা। সনাতন তথা হিন্দু ধর্ম, সম্প্রদায় ও তাদের উৎসব সম্পর্কে অনেক ধারনাই জন্মে কিশোর বয়সেই। কারন, অনেক সহপাঠী ও প্রতিবেশি  ছিল হিন্দু। 

খৃষ্টান ও খৃষ্টান ধর্ম সম্পর্কে আমি প্রথমে যা  শুনেছি তা মৌলভীদের ধর্মসভা বা ওয়াজ থেকেই। কেবল খৃষ্টধর্ম ও সম্প্রদায় নয়, আমার  দুনিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞান ভূগোল ইতিহাসের প্রাথমিক তথ্যসম্বল ছিলো ঐ ওয়াজই। যদিও তার সিংহভাগই ছিলো ভুল ও বিভ্রান্তিতে ভরপুর! মৌলভীদের ওয়াজই ছিলো আমার দ্বীন দুনিয়ার প্রাথমিক তথ্যসম্বল। আজকাল তো ওয়াজ নামের তথ্যসম্বলের ধারকবাহকের সংখ্যা আরো বেড়েই গেছে। আর সে সময় দু একজন স্থানীয় ধর্মান্তরিত খৃষ্টান কোন বাড়ির উঠোনে, বা বাজারে, বা কোন গলিত, বা কলোনিতে একটি ছোট পর্দায় যীশু খৃষ্টের  উপর নির্মিত সাদাকালো আজকের টেলিফিল্ম  এর মত একটা কিছু দেখাতো। তা অনেকেই দেখতাম তবে তা বছরে দু একবার। এখন তেমনটা দেখায় কিনা জানি না। খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে জেনেছি অনেক পরে। ভ্রমণ করে, পড়ে পড়ে। খৃষ্ট ধর্ম বিষয়ে জানা পড়াও কঠিন কাজ ছিল  আমাদের সমাজে। কারন আমার সমাজ ও ধর্ম, আমাকে খৃষ্টান ও খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচাক ধারনা দিয়ে বড় করেছিলো।

খৃষ্টানেরা যাকে যীশু বলেন, আমরা যারা  মুসলিম পরিবারে জন্মেছি, তারা তাকে ইসা নবী হিসেবে জানি। অর্থাৎ মুসলিমরা যীশুকে বলে 'হযরত ইসা (আঃ) আলাইহিসসালাম'। খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, যীশু মরে গেছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যীশু অর্থাৎ ইসা (আঃ) মরেননি। তাকে চতুর্থ আকাশে তুলে নেওয়া হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছা ও হুকুমে। আর যাকে ক্রুসবিদ্ধ করা হয়েছে, তিনি যীশু ছিলেন না। যারা যীশুকে খুন করতে চেয়েছিলো তাদের মধ্য থেকেই একজনকে আল্লাহ, যীশুর রূপ দিয়ে ছিলেন। এবং ইসা আঃ আবার একদিন, এই পৃথিবীতে আসবেন। এটাই মুসলিমদের বিশ্বাস।  ইসলামী পরিভাষা তথা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে দুই হাজার বিশ বছর ধরেই ইসা আঃ বা যীশু চতুর্থ আকাশে অবস্থান করছেন! দ্রষ্টব্য, ইসলামের পরিভাষায় আকাশ সাতটি। সেই সাতটির একটি হলো, চতুর্থ আকাশ। সেখান থেকেই যীশু বা ইসা আঃ পৃথিবীতে নেমে আসবেন। ইসলামী পরিভাষায়, ইসা কেন পৃথিবীতে নেমে আসবেন তা অন্য দিন লিখবো।

বাংলাদেশে বড়দিনে সরকারী ছুটি থাকে। মুসলিমরা অবশ্য বড়দিন বা ক্রিসমাস পালন করে না। তবে ইসা আঃ কে আল্লাহর প্রেরিত মহামানব মনে করে। যীশু বা ইসা আঃ এর জন্মের ইতিহাস  সম্পর্কে মুসলিম ও খৃষ্টীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাস প্রায় একই রকম। যীশু বা ইসার কোন পিতা ছিলেন না। গড বা আল্লাহর ইচ্ছাতে পুরুষের শুক্রাণু ব্যতিতই মরিয়ম নামে একজন নারীর গর্ভে ইসা বা যীশুর জন্ম। খৃষ্টানরা তাই গডকেই যীশুর পিতা অভিহিত করে  থাকেন। ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসে আল্লাহ কোন সন্তান জন্ম দেন না, তিনি কারো জনকও নন। তাই মুসলিমদের খৃষ্টীয় মতে সায় দেয়ার সুযোগ নেই। তবে খৃষ্টান ধর্মালম্বীরা যাকে মাদার মেরি  বলেন; মুসলিমরা তাকে বিবি মরিয়ম হিসেবে ভীষণ শ্রদ্ধা করে থাকে।

কেউ কেউ মনে করেন খৃষ্ঠীয় প্রথম শতকেই ভারত উপমহাদেশে খৃস্টীয় মতের প্রচার শুরু হয়। অনেকে মনে করেন এ উপমহাদেশে খৃষ্ট ধর্মের প্রচার শুরু হয় ১৫ বা ১৬ শতক থেকে।আবার কারো কারো মতে পর্তুগীজ খৃষ্টান ব্যবসায়ীদের কর্তৃক সমূদ্র উপকূলে জোড়পুর্বক খৃষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে ভারতীয়দের। এসবই ইতিহাসের তর্ক বিতর্ক ও গবেষণার বিষয়। ভারতবর্ষের খৃষ্টান সম্প্রদায়ের একটি চমৎকার ইতিহাস রয়েছে। তারা কিন্তু ভারত বিভক্তি চায়নি। এমনকি ভারতীয়দের স্বরাজ আন্দোলনেও সমর্থন দিয়েছে। সম্ভবত ধর্মান্তরিত খৃষ্টানরা ভারতীয় ধর্মকে ত্যাগ করলেও ভারতীয় সভ্যতা  সংস্কৃতিকে ভুলে যেতে পারেনি। 

অদ্ভুত বিষয়, খৃষ্টানদের এই বড়দিন উৎসবটি খোদ খৃষ্টান ধর্মগুরুদের দ্বারাই একসময় নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো। কট্টর খৃষ্টধর্ম গুরুরা আজকের এই বড়দিন বা যীশুর জন্মদিন পালনকে অখৃষ্টীয় কাজ মনে করতেন। যেমন, এ উপমহাদেশে মুসলমানেরা নবী মুহাম্মদ এর জন্মদিন বা ইদে মিলাদুন্নবী পালন নিয়ে আজো দুই ভাগে বিভক্ত। আজ পর্যন্ত আমি কোন বড়দিনের অনুষ্ঠানে যাইনি। তাই ব্যক্তিগত ভাবে বড়দিন উৎযাপন করার কোন আনন্দ ও  অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারছি না। ইসলামের কট্টর ধর্মগুরুদের মতে একজন মুসলিম অন্য কোন সম্প্রদায়ের ধর্মোৎসবে অংশ নিতে পারে না। এমন কি শুভেচ্ছাও জানাতে পারবে না! আমি তো মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছি, আমি কি বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারবো? আচ্ছা আমি অখৃষ্টান হয়ে যদি খৃষ্টানদেরকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাই। তবে কট্টর খৃষ্টীয় ধর্মগুরুরা, সাধারণ খৃষ্টানদের সে শুভেচ্ছা গ্রহন করতে অনুমতি দেবে কি? আজকাল শুভেচ্ছা দেওয়া নেওয়াতে ভয় হয়। কারন, এ উপমহাদেশে মৌলভী, পাদ্রী, পুরোহিতের অলিখিত 'রাজ' চলছে যে! 

(www.theoffnews.com - Bangladesh Xmas Merry Christmas)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours