মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:
ছোটবেলা থেকেই বাড়ির সকলের ফুটবল নিয়ে পাগলামি আমারও জিনগত হয়ে পড়েছিল। তার ওপর আমার কাকু প্রয়াত শ্রী বরুন মিশ্র ছিলেন একসময়ের মোহনবাগানের ফুটবলার। বাড়ির ছেলেদের সাথেই আমাদের ফুটবলপ্রীতিও বাড়তে থাকে সময়ের সাথে। রেডিওতে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের খেলা শোনা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে টিভিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখায় বদলে গিয়েছিল। বাবা কাকাদের মুখে পেলে, বেকেনবাওয়ার ইত্যাদি নাম শুনে শুনে বুঝতাম এনারা বড় মাপের খেলোয়াড়। নিজেদের বাড়িতে তো দূর পাড়াতেও তেমন টিভি ছিল না কারো ঘরে। তাই আমার কেবল ফুটবলারদের গুণাবলী শোনা হত। দেখার সুযোগ হত না খুব একটা।
তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৮৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ। একটা বেঁটে ছেলে নাকি ভেল্কি দেখাচ্ছে ফুটবল নিয়ে। বাবার মুখে শুনলাম। তখন ক্লাস এইট। বড় হয়েছি একটু। তাই অনেকটা পথ হেঁটে জেঠুর কোয়ার্টারে বাড়ির ছেলেদের সাথে ঐ ছেলেটার খেলা দেখতে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। বাড়ির সকলের প্রবল সাপোর্টের ব্রাজিলের হলুদ রঙ সেই থেকে আমার কাছে নীল সাদা আর্জেন্টিনা হয়ে গেল। আমি শুধু দেখছিলাম একটা কোঁকড়া চুল ছেলে অসাধারণ ড্রিবলিং করে বিপক্ষের তাবড় তাবড় ফুটবলারদের নাস্তানাবুদ করছে। আমার সেই কিশোরী চোখে মায়াকাজল পরিয়ে দিল সেই ছেলেটি। তারপর থেকেই দিয়েগো আরমেন্দো মারাদোনা ফ্রাঙ্কো কেবল আমার নয় সমগ্ৰ ফুটবল পাগল বাঙালির এবং বিশ্বের কাছে ফুটবলের রাজপুত্র হয়ে প্রতিষ্ঠা পেল।
মারাদোনা, এক অদ্ভুদ আবেগের নাম। বর্ণময় বিতর্কিত চরিত্র, ততোধিক বিতর্কিত জীবনযাপন। তবুও তিনি ফুটবল প্রিয় মানুষের কাছে এক অন্যরকম ভালোবাসার মানুষ ছিলেন। ভগবানের হাত হোক বা মাদক কেলেঙ্কারি, তিনি সবসময় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। এত কিছু সত্ত্বেও তিনি আমাদের মনের মানুষ হয়ে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
ফুটবলার আসবে যাবে কালের নিয়মে। কিন্তু মারাদোনা তাঁর নিজস্বতা, রাজকীয় খামখেয়ালী জীবনযাপন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে এক অন্য মাত্রার ফুটবলার ছিলেন। এখনো মনে পড়ে প্রথম ড্রাগ নেওয়ার অপরাধে তাঁকে যখন বিশ্বকাপের মাঝপথে টিম থেকে বাদ দেওয়া হোল, তখন হাউহাউ করে কেঁদেছিলাম। শুধু মারাদোনার জন্যই আজও আর্জেন্টিনার হয়ে গলা ফাটাই। নীল সাদা দশ নম্বর জার্সি মানেই ফুটবল পাগলদের কাছে মারাদোনা। যার পায়ের জাদুতে আচ্ছন্ন বিশ্ব ফুটবল। আচ্ছন্ন আমরা।
তাঁর অসাধারণ ফুটবল প্রতিভার সাথে সমস্ত কেলেঙ্কারি, উশৃঙ্খল জীবন যাপন, সব কিছু নিয়েই তিনি আমাদের কাছে ভালোবাসার দিয়েগো মারাদোনা।
তাঁর পায়ে বল পড়লেই যেমন গোটা স্টেডিয়াম মা-রা-দো-না শব্দে ঝড় উঠত তেমনি এখনো তাঁর নামে বুকের মধ্যে ঝড় ওঠে। আসলে মারাদোনা এক আবেগের নাম।
তাই বোধহয় এই লেখাটা লিখতে লিখতে চোখের জল গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। ফুটবলের রাজপুত্র আর নেই ভাবতেই যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠছে অন্তর। আমার মতই আজ ফুটবল প্রেমীদের মনে ঝড় বইছে।
২০২০ কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রিয়জন। মারাদোনার চলে যাওয়াটাও প্রিয়জন বিচ্ছেদের মতই। বড় কষ্টের। কালের নিয়মকে মেনে নিতেই হবে জানি। তিনি পার্থিব শরীর ত্যাগ করলেও আমাদের মনে আমাদের আবেগে মিশে থাকবেন চিরকাল। ভালোবাসি তোমায় মারাদোনা। ঈশ্বরের স্টেডিয়ামে ভালো থেকো মারাদোনা।
খুব সুম্দর করে আমাদের হৃদয়ে ম্যারাডোনারউপস্থিতির কথা তুলে ধরেছো। সত্যি তো মারাদোনা এক অন্য ফুটবলের জগৎ এক অন্য রকম ভালোবাসা এক অন্য রকম আকর্ষণ।
ReplyDelete