গতকাল ছিল ১১ই নভেম্বর; ন্যাশানাল এডুকেশান ডে। মহাসমারোহে পালিত হয়েছে দিনটি। কিন্তু সত্যিই কি শিক্ষার আলো আসমুদ্র হিমাচলের খাঁজে ও ভাঁজে বিস্তারির হতে পেরেছে? নাকি এক অজানা ধূসর, বিষাক্ত চাদরে ঢেকেছে শিক্ইত মানুষের মন; এই নিয়েই আজকের প্রতিবেদন “শিক্ষায় আলো”।
১১ই নভেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শিক্ষাবিদ মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন। তিনি বলেছিলেন, শিক্ষা প্রত্যেক মানুষের অধিকার, যা একটি মানুষের প্রতিটি রন্ধ্রকে উন্নত করে; তাকে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচতে সাহায্য করে। শিক্ষাই একমাত্র অস্ত্র যা হৃদয়কে এতটাই সমৃদ্ধ করতে পারে যে তার দ্বারা সমাজে বিপ্লব আনা সম্ভবপর হয়। শিক্ষাই প্রাথমিকভাবে এমন পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে যাতে মানুষ বন্ধুত্ব এবং সমতাকে সমাদর করতে পারে।
শিক্ষাদিবসের নামে প্রতিবছর এই দিনে আমরা তাঁকে স্মরণ করছি, স্বাধীনতার যুদ্ধে ও শিক্ষা জগতে তাঁর অবদানকে সম্মানিত করছি ঠিকই, কিন্তু সত্যিই কি তাঁর উত্তরসূরীরা, ভারতমাতার ১৩০ কোটি সন্তানেরা প্রত্যেকে আজ প্রকৃত শিক্ষিত? হ্যাঁ। ভারতবর্ষের উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করা ছাত্র=ছাত্রীদের অভাব নেই। উচ্চশিক্ষিত হয়ে কত সুযোগ্য সন্তান পৃথিবীর কোনে কোনে কত ধরণের সাধনার কাজে ব্রতী হয়েছেন; তাঁদের কেউ বিজ্ঞানী, কেউ ডাক্তার, কেউ ভূতত্ত্ববিদ কেউ আবার মনোবিদ, সাহিত্যিক অথবা অর্থনীতিবিদ। ভারতীয় বংশভূতরা বিশ্ব রাজনীতিতে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত; স্পেসে সাফল্যের সঙ্গে যাত্রা সম্পূর্ণ করেছেন। কিন্তু তাতে তো এটা প্রমাণ হয়না সামগ্রিকভাবে সমস্ত ভারতবাসী; আমাদের ঘরের মা-বোন ভাই ছেলেরা উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করেছেন।
পুঁথিগত বিদ্যাই তো আসল শিক্ষা নয়। একজন মানুষ সারাজীবন ধরে শিক্ষা পেয়ে থাকেন জীবনের থেকে, প্রকৃতি থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে, উপলব্ধি থেকে। কিন্তু কতখানি শিক্ষা আমরা সুষমভাবে বন্টন করতে পারছি বা পেরেছি? কথায় বলে, বিদ্যা দান করলে বাড়ে। অথচ আজকের দিনে আপনি একজন মানুষকে কিছু ভালো শিক্ষা দিতে যান, তিনি হা হা করে উঠবেন; বিভিন্নরকম অঙ্গভঙ্গি করে হয়তো বলবেন, “রাখুন মোশাই জ্ঞান দিতে আসবেন না!” আসলে তিনি মনে করেন তার শিক্ষা লাভ সম্পূর্ণ হয়েছে আর এইভাবনাটাই সবচাইতে বড় অশিক্ষা। আজকের মানুষের দিতেও আপত্তি, নিতেও আপত্তি।
এই যে রাজনৈতিক মঞ্চে কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন রকম চটকদারী ভাষায় ভাষন দেন; তাতে না থাকে সম্মান না থাকে সম্ভ্রম; ভাষার মাত্রা কোথায় টানতে হয় আর কোথায় থামতে হয়, সে বোধজ্ঞানটুকুও যখন লোপ পায় আর সেই ভাষন শুনে যখন উপস্থিত জনতা হাততালি দিয়ে ওঠে, মনে হয় নাকি আমাদের দেশের প্রতিটি কোনে কোনে, অলিতে গলিতে কুশিক্ষার চাষ চলছে! সে কুশিক্ষার পরিমাণ এতটাই বেশি যে নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত কৃতী সন্তানকেও অপভাষা প্রয়োগে অসম্মানিত করতে দ্বিধা বোধ করেন না।
শিক্ষা আমাদের প্রাথমিক চাহিদা ও অধিকার। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র সেইখাতে কতটুকু টাকা বরাদ্দ করেন?? বেসরকারী স্কুল, কলেজ আজ ব্যবসায়িক প্রতোষ্ঠানে পরিণত। সরকারী স্কুলগুলোতে পড়ুয়ার হার বাড়াতে মিডডে মিল, ভাতা, উপঢৌকনের টোপ দিতে হয়। তবুও গ্রামে, বস্তিতে, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা তাদের প্রতিটা কথার আগে পরে গালি ব্যবহার করতে পিছপা হয় না। কিছু কিছু প্রদেশে গালগাল দিয়ে কথাবলাটা তো রীতি-রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
আমাদের বাঙালী জাতি শিক্ষিত জাতি হিসেবে শুধু দেশ নয় বিদেশে থেকেও যুগে যুগে যথেষ্ট সম্ভ্রম কুড়োতে সক্ষম হয়েছি। সেই সূত্রেই বাংলা সাহিত্য এত সমৃদ্ধ আর প্রতি দশকে কোন না কোন মনীষী বা উঁচুদরের সাহিত্যিক প্রকৃত শিক্ষার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিতে। যেমন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের কথা আমরা ভুলতেই পারি না। আমাদের শয়নে, স্বপনে, জাগরণে রবীন্দ্রনাথ মিশে আছেন। তাঁকে ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টির কথা ভাবতেই পারি না। অথচ আমরা সেইসকল মহাপুরুষ ও নারীদের আদর্শকে অনুসরণ করা তো দূরে থাক; নিজেদেরকে হয়তো তাঁদের থেকেও বিজ্ঞ ভেবে বসে রয়েছি। তাইতো তাদের নিয়ে অহেতুক সমালোচনা করি; তাঁদের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পছন্দ করি। আবার কারণে অকারণে মূর্তি ভাঙা ও গড়া নিয়ে রাজনীতি করতেও ছাড়ি না। রামকৃষ্ণ দেবের রুপকধর্মী গল্পগুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি। স্বামী বিবেকানন্দের রেখে যাওয়া জীবনদর্শন নিয়ে নোংরা রাজনীতি করি।
কথায় বলে, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী। আসলে হয়েছে কি আমরা সকলে মহমূর্খ কালিদাস হবার খাতায় নাম লিখিয়েছি। কালিদাস তো সাধনার দ্বারা মহাবিদ্যা অর্জন করে বিক্রমাদিত্যের সভা আলো করেছিলেন। আর আমরা হয় যে ডালে বসে আছি সে ডালটাই কাটছি আর নয়তো শিক্ষার অহংকারে অহংকারী হয়ে চামড়ার বদলে সোনার জুতো পরে হাঁটছি।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নর্দমার কালো জল। অন্ধ কুসংস্কারচ্ছন্ন মন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরেও নারী-পুরুষ বিভাজন, হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে রদ করা গেল না। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে ধর্ষন, শ্লীলতাহানি ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। উচিৎ শিক্ষা না থাকার জন্য দূর্নীতিগ্রস্থ লোকের সংখ্যা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে! আমরা মন্দিরে, মণ্ডপে আলোর রোশনাই দেখতে ছুটে যাচ্ছি। সূর্যোদয় দেখতে পাহাড়ে চড়ছি, সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাচ্ছি; অথচ প্রদীপের নীচে কালো অন্ধকারটাকে দূর করতে এগিয়ে আসছি না।
অনেক হয়েছে; গঙ্গা যমুনা, সাগরের জল গলার কাছে এসে উপস্থিত। এখনও যদি নিজেরা সতর্ক না হই; সত্যিকারের শিক্ষার আলোকে প্রসারিত করতে যদি না পারি; তাহলে টাইটানিকের মতো যে কোন দিন ডুবে যাবো আর উদ্ধার করতে কোন ঈশ্বরের দূত ছুটে আসবে না। তাই আসুন নিজেরা নিজেদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই শুধুমাত্র একটা দিবস উজ্জাপন নয়; শুধুমাত্র আলোর উৎসব দীপাবলীতে অংশগ্রহণ নয়; নিজেরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হই; গুড লিসেনার হই; গুড অ্যাডভাইসার হই; ছড়িয়ে দিই আমাদের স্বল্প-অধিক জ্ঞানের আলো দিকে দিকে; অসহায় একটি শিশুকে অন্তত্য প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে সাহায্য করি।
আর হ্যাঁ। সবচাইতে বড়ো কথা, ভাষা কখনোই শিক্ষার ব্যারিয়ার হতে পারে না। তাই অন্য ভাষাকেও যেমন সাদরে গ্রহণ করবো তেমনি মাতৃভাষাকেও সম্মান জানাবো। জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতিকে বরদাস্ত করবো না। প্রতিবাদের ভাষায় আঙুল তুলে বলবো, “আমি ভয় করবো না ভয় করবো না...দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না...”
প্রতিটি ভারতবাসীর ভাষায়, প্রত্যেকজনের কথায়, সকলের ভাবনায় শিক্ষার আলো প্রকাশিত হোক নতুন সূর্যের আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক দিক থেকে দিগন্তরে, এই শুভকামনা জানিয়ে আজকের প্রতিবেদন এইখানেই সমাপ্ত করছি। মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours