সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:

পূজোপর্ব শেষের বিষণ্নতায় আমরা মগ্ন। মা দুর্গাতো ফিরেই গেছেন কৈলাশে, দীপাবলিও যাব যাব প্রস্তুতি। মায়ের ময়ূরবাহন পুত্র তাই এবার মহামায়া মায়ের সাথে ফিরে চললেন অনন্ত ধামে? তিনি চলে গেলেন আজ। আচ্ছা এই কৈলাসের আশেপাশেই কি না ফেরার দেশ? 

মা গেলেন পিছনে রয়ে গেল করোনা আক্রান্ত মানুষজন। মানুষের আবেগ আকাঙ্ক্ষা আশা আজ যেন বড়ই হতাশ। উৎসবের আতিশয‍্যে মানুষ কি বোধ বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল নাকি করোনার হতাশায় মানুষ বড্ড বেশী দুঃসাহস দেখিয়ে ফেলল? 

বাঙালি আত্মসর্বস্ব জাত এমন নিন্দা কেউ করবেন না কিন্তু বাঙালি সত্যি কি আত্মঘাতি জাতি?

উৎসবের আনন্দে কোথাও কি নিজের জন‍্য গণমৃত‍্যু মিছিলে যোগ দিল জাতিটা? কি করেনি এই জাতিটা নোবেল দিয়েছে অস্কার দিয়েছে। ফ্রান্সের সর্ববোচ্চ পুরস্কার এনেছে। 

যার হাত ধরে এসেছে তিনিও পা রাখলেন না ফেরার দেশে। হ‍্যাঁ পুলুদার কথা বলছি। পুলুদার চলে যাওয়ার সাথে সাথে একটা যুগ শেষ হল। মহানায়ক উত্তমকুমারের সমসাময়িক নায়ক সৌমিত্র। মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যদিও সৌমিত্র ছিলেন ছোটো। মহানায়ক তখন মধ‍্যগগনে কি তার দাপট! কি তার তেজ! মহানায়ক সূর্য হলে সৌমিত্র হলেন অন‍্য গ‍্যালাক্সির নাম না জানা কোনো এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। দুজনের আলোকছটায় কেউই কারোর চোখ ধাধা লাগাতে পারেনি। নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বমহিমায় দুজনেই ছিলেন সমভাবে উজ্জ্বল।

উত্তম কুমার চলে যাওয়ার পর বাংলা চলচ্চিত্র যিনি শিবরাত্রির সলতের মত আগলেছেন তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অভিভাবকও বটে। করোনা আবহে টলিপাড়া এমনিতেই ধুঁকছে, আজ যেন অভিভাবকহীন।  সত‍্যজিত রায়ের "অপু" তাঁর সংসারের মায়া কাটিয়ে ছায়াছবির জগৎ থেকে পাড়ি দিলেন কোন এক মায়ার দেশে। বিশ্বজুড়ে গুণমুগ্ধ মানুষজন একমনে অন্তর থেকে বলেছেন ফাইট ফেলুদা ফাইট। যেভাবে আপনি বলেছেন ফাইট কোনি ফাইট।

কোথাও কি অভিমান কাজ করেছে? জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত নিজেকে ভালবেসে অভিনয়ে যুক্ত রাখলেন। খালি মন বলছে আপনি সেই দরাজ গলায় বলে উঠবেন, "তোমরা বিহ্বল কেন তোমরা কেন হতাশ এত? কিচ্ছু দেখোনি কিছু বোঝোনি। ঠিক যেভাবে আপনাকে বলা হয়েছিল "মাষ্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছু  দেখেননি।"

মনে পড়ে ঝিন্দের বন্দি মুভির কথা? নায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে ময়ূরবাহন লম্পট ক্রূর অথচ চেহারায় কন্দর্পনারায়ন সুদর্শন। উত্তমকুমার রেইনিং কিং আর সৌমিত্র রাইজিং স্টার। "অপুর সংসার" য়ে নায়ক থেকে একেবারে খলনায়ক। চেহারা নায়কোচিত কিন্তু চোখে মুখে ক্রূরতা। একেই বলে অভিনয়ের মুন্সীয়ানা।

আপামোর বাঙালির চোখের মণি অপু কিম্বা আদরের ফেলুদার মধ‍্যে ময়ূরবাহনকে এযুগের নেক্সজেন বাঙালি চেনেই না। 

ময়ূরবাহন সেলুলয়েড ঝিন্দে বন্দি হয়েই রইলেন। 

প্রথম জীবনে আকাশবাণীর ঘোষক, তারপর শিশিরভাদুড়ির হাতধরে মঞ্চে, সেলুলয়েডে এলেন সত‍্যজিত রায়ের হাত ধরে। তারপর একে একে পরিচালকরা দিয়েছেন নানা রূপে 

নায়ককে। তপনসিনহার ক্ষুধিতপাষাণ, অজয়করে সাত পাকে বাঁধা, দিনেন গুপ্তর বসন্তবিলাপ। অপর্ণা সেন এর পারমিতার একদিন শিবপ্রসাদ নন্দিতা জুটির বেলাশেষে, প্রাক্তন পোস্ত নানা রূপে নানাভাবে। শেষের কবিতায় তার আবৃত্তি 

"ওগো বন্ধু,

সেই ধাবমান কাল

জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার

জাল.."

ময়ূরবাহন, করোনার ঘূর্ণিপাকে আটকে গেলে! আবৃত্তি কানে আসছে

...তুলে নিল দ্রুতরথে

দু’সাহসী ভ্রমনের পথে

তোমা হতে বহু দূরে।

মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে

পার হয়ে আসিলাম

আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;

রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়।

ময়ূরবাহন ময়ূররথ তৈরি, বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন রাজার জন‍্য। কানে আসছে কালজয়ী গানটা,

যদি সব ছাড়িয়ে 

দুটি হাত বাড়িয়ে

হারাবার খুশিতে

যাই শুধু হারিয়ে 

যেতে যেতে কারো ভয়ে

থমকে দাঁড়াব না

সামনে যা দেখি, জানি না সে কি 

আসল কি নকল সোনা... 

বেলাশেষে হীরকরাজার দেশের ছাইচাপা খাঁটিহীরে "উদয়ন পন্ডিত" চলে গেলেন না ফেরার দেশে হেমন্ত বিলাপে।

কালীরূপী কৌশিকী দুর্গা কি অপুর জন‍্য অপেক্ষায়? শরৎ শেষে কাশের বনে কেমন দোলা দিচ্ছে! কু ঝিক কু ঝিক.....জীবনের শেষ ট্রেনটা চলে গেল।

ময়ূরবাহনের ময়ূররথ আজ দূরে বহুদূরে, হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে প্রথম কদম ফুলের অপেক্ষায়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours