মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

রাজস্থানের ঝুনঝুনু জেলায় চারশো বছরের পুরোনো এই মন্দির দাদীমা কি মন্দির নামে পরিচিত। অনেক খানি জায়গা জুড়ে এই মন্দির প্রাঙ্গনে, ঢোকার মুখেই বিশাল গেটের ওপর সিংহবাহিনী দেবী মুর্তি। স্থানীয় মানুষ ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে রাজস্থানীরা আসেন এই মন্দিরে মানত করতে। তাদের বিশ্বাস এখানে মানত করলে ইচ্ছা পূরণ হবেই। মন্দির প্রাঙ্গণে মহাদেব, গণপতি রাম, সীতা ও হনুমানজীর মন্দিরও আছে। আসল মন্দিরে ফোটোগ্রাফী তোলা মানা—সেখানে বিশাল চত্ত্বর জুড়ে তেরোটি সতীমাতার মন্দির। একটি প্রধাণ বাকী বারোটি ছোটো মন্দির একপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। সুন্দর মার্বেল পাথরের ওপর নানা রঙের মীনাকারির কাজ দিয়ে সাজানো মন্দিরের মেঝে দেওয়াল অপূর্ব শৈল্পিক কর্মের সাক্ষর। প্রাঙ্গণের মাঝে একটি বিশাল ত্রিশূল, সেটিই পূজো হয়।

মন্দিরে ভক্তদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শৌচালয়, চারিদিকে সিকিউরিটি গার্ডের ছড়াছড়ি।

মন্দিরের ইতিহাস বাইরের বইয়ের দোকানে হিন্দীতে লেখা একটি পাতলা বইতে পাওয়া যাচ্ছে। চারশো বছর আগে হরিয়ানার প্রান্তে  মহম নগরে আগরওয়াল পরিবারে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে কন্যা-দেবী দুর্গার নামে তার নাম রাখা হয় নারায়ণী। ছোটো থেকেই সব রকম খেলাধুলা, ঘোড়া চালানো, তীর ছোঁড়ায়, অসি চালনায় দারুন পারদর্শী ছিলেন। কথিত আছে ছোটো থেকেই ওনার কিছু বিশেষ ক্ষমতা ছিল---তাদের গ্রামে মাঝে মাঝেই এক ডাইনি এসে ছোটো বাচ্ছাদের তুলে নিয়ে যেত। নারায়ণীর এক বান্ধবীকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে নারায়ণী পথ আটকে দাঁড়াতেই সে ডাইনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং তারপরে দেবীকে চিনতে পেরে ক্ষমা চায়।

এরপরে হিসার রাজ্যের দেওয়ান জালান্ধরজীর ছেলে তনধনদাসজীর সাথে নারায়ণীর বিবাহ ধুমধাম সহকারে সম্পন্ন হয়। যৌতুকে নারায়ণীর পিতা ঘুর্সমালজী মুল্যবান নানান সামগ্রীর সাথে একটি শ্যামকর্ণ ঘোড়া উপহার দেন জামাতা তনধনদাসজীকে। অতি সুন্দর ঘোড়াটি ছিল তনধনদাসজীর ভারী প্রিয়। তাতে চড়েই তিনি শ্বশুরবাড়ী যাতায়াত করতেন। হিসার রাজ্যের নবাবের তখন সারা উত্তর ভারতে প্রবল প্রতিপত্তি। নবাবের পুত্রের ভারী পছন্দ হল দেওয়ান পুত্র তনধনদাসজীর সেই শ্যামকর্ণ ঘোড়াটি। এর ওপর নবাব পুত্রের বন্ধুরাও তাকে উসকানি দিতে থাকে যাতে ঘোড়াটি দেওয়ান পুত্রের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। নবাব চাপ দিয়ে দেওয়ানের কাছ থেকে ঘোড়াটি নিজের পুত্রের জন্য যোগাড় করতে চেয়েও ব্যর্থ হন কারণ ঘোড়াটি দেওয়ানের নয় তনধনদাসের যৌতুকে পাওয়া।

এরপর অতর্কিতে নবাবপুত্র আক্রমন করেন দেওয়ানের হাভেলী,---উদ্দেশ্য ছিল শ্যামকর্ণ ঘোড়াটি ছিনিয়ে আনা। কিন্তু ভালের আঘাতে মারা যান নবাবপুত্র আর সে রাতেই  সপরিবারে হিসারের দেওয়ান পালান পাশের শক্তিশালী শত্রু রাজ্য ঝুনঝুনুতে। বর্তমানে ঝুনঝুনু রাজস্থানে। হিসারের নবাব পুত্রশোকে পাগল হলেও ঝুনঝুনুর মত শক্তিশালী রাজ্য আক্রমন করে যুদ্ধ ডাকতে চাননি সেই মুহূর্তে।

রাজস্থানে  মেয়েদের বিয়ে সাত আট বছরেই দিয়ে দেওয়া হলেও তারা শ্বশুরবাড়ী যেত পনেরো ষোলো বছর বয়স হলে---একে বলে মুকলাবা। কয়েক বছর পরে নারায়ণীর বাবাও শুভমুহূর্ত দেখে মুকলাবার উদ্দ্যেশ্যে নিমন্ত্রণ করলেন জামাই তনধনদাসজীকে মহম নগরে।অনুষ্ঠানের দিন চারেক আগেই এসে পৌঁছান তনধনদাসজী তাঁর শ্যামকর্ণ ঘোড়ায় চেপে।

মুকলাবা শেষ হতেই পাল্কিতে নারায়ণীকে চাপিয়ে ঝুনঝুনুর দিকে  রওনা দেন তনধনদাসজী। যাত্রার দিন সকাল থেকেই ছিল নানান অশুভ সংকেত তবু সব অগ্রাহ্য করে যাত্রা করেন তনধনদাসজী নারায়ণী সহ, সঙ্গে অল্প ঝুনঝুনুর সৈনিক। ঝুনঝুনুর পথে দেবসার নামে এক জায়গায় হিসার সৈন্যরা অতর্কিতে  আক্রমন করে, প্রচন্ড লড়াই চলে। তনধনদাসজী ও ঝুনঝুনার সৈনিকরা মারা যান। এরপর কি ঘটছে বুঝতে না পেরে পাল্কি থেকে বেরিয়ে আসেন নারায়ণী। স্বামীর মৃতদেহ দেখে উপস্থিত হিসার সৈন্যদের একাই কচুকাটা করেন। চারপাশে মৃতদেহ আর রক্ত স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে চীৎকার করতে থাকেন নারায়নী—“কোই হ্যায় তো বাহার আও।“ শ্যামকর্ণ ঘোড়ার সেবক রাণাজী একমাত্র বেঁচেছিলেন। তাকে দেখেই নারায়ণী বলেন—“সূর্যাস্ত হতে যাচ্ছে, চিতা সাজান রাণাজী, আমি সতী হতে চাই।“ রাণাজী বারবার ঝুনঝুনু যেতে বললেও নারায়নী সহমরণে যান আর নির্দেশ দেন তিনদিন পরে চিতা ঠান্ডা হলে সেই ছাই চুনরীতে বেঁধে ঘোড়ার পিঠে চেপে রাণাজী যেন ঝুনঝুনু ফেরেন। ঘোড়া যেখানে থামে সেখানেই চবুতারা বানিয়ে ভষ্ম রাখা হয়। আজ সেখানেই রাণী সতী মাতা মন্দির। অনেক অলৌকিক ঘটনাও জুড়ে আছে এই মন্দির ঘিরে। 

তবে মন্দিরের  নানান জায়গায় লেখা আছে তাঁরা সতীদাহ প্রথা সমর্থণ করেন না। মন্দিরটি ঝুনঝুনু বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন কিমি দুরে, জয়পুর বা দিল্লী থেকে বাসে অথবা ট্রেনে ঝুনঝুনু আসা যায়। কাছেই পিলানীতে বিড়লাদের প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট বিটস পিলানী খুবই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান।

(ছবি সৌজন্যে: প্রতিবেদক স্বয়ং)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours