তৃপ্তি মিত্র, লেখিকা ও আবৃত্তিকার, কলকাতা:

ছোট বেলা থেকেই আমরা পাঠ্য বই এর সুবাদে জেনে গেছি কলকাতা নগরীর গোড়াপত্তন করেছেন জবচার্নক৷ এ নিয়ে জনমনে বিরূপ মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি বহুবছর৷ এমন কি একুশ শতকের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়েও আমরা এই চরম মিথ্যেটাকে (?) সত্যি বলে জানি৷

দীর্ঘকাল ইতিহাস রচয়িতাগণ কলকাতার ইতিহাস লিখতে আগ্রহী হননি। আবার এও শোনা যায় কলকাতা প্রেমিক সাহেবরা তাদের বাঙ্গালী ভক্তকুলকে কলকাতা চর্চায় কিছু সীমাবদ্ধতা রেখেছিলেন। অপর দিকে ইংরেজ লেখকরা  কলকাতার ইতিহাস রচনা কালে কলকাতার গোড়াপত্তনের মুলে এক বাক্যে জবচার্নককে প্রতিষ্ঠাতার আসনে বসিয়ে ছিলেন। 

প্রাণকৃষ্ণ দত্ত প্রথম বাঙালী যিনি বাংলা ভাষায় কলকাতার ইতিহাস লিপি বদ্ধ করেছিলেন। তিনি ১৩০৮ সালের আশ্বিন থেকে শুরু করে ১৩১০ সালের মাঘ পর্যন্ত "নব্যভারত" পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন "কলকাতার ইতিবৃত্ত" শিরোনামে তাঁর চৌষট্টিটি তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ৷

প্রাণকৃষ্ণ দত্ত এবং অতুল চন্দ্র রায় এঁনারা দুজনেই যথাযোগ্য গুরুত্ব ও ব্যখ্যা দিয়ে কলকাতার সূচনা কালের বর্ণনা করেছেন৷

ইংরেজ ইতিহাসবিদেরা যে ভাবে কলকাতার বর্ণনা করেছেন, প্রাণকৃষ্ণ দত্ত সে প্রথা অনুসরন করেননি। তিনি শুরু করেছেন আদিম বা প্রাক চার্নক যুগ নিয়ে৷ যেখানে উঠে এসেছে কলকাতার নামোৎপত্তি, জনপদ পরিচয়, কালীঘাট, গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও সন্নিহিত অঞ্চল সমূহের বর্ননা৷ অর্থাৎ প্রাণকৃষ্ণের ইতিহাসে প্রাক চার্নক ও উত্তর চার্নক দুই যুগের ইতিহাস আছে ৷

কলকাতার ক্রমবিবর্তনে সাহেবদের অবদান অস্বীকার করার জায়গা নেই৷ ইংরেজদের কাছে কলকাতা ছিল ভালোবাসায় আবৃত এক স্থান৷ যেখানে তাঁরা তাঁদের ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটাতে কলকাতাকে বেছে নিয়েছিল৷ তাঁরা তাদের প্রাণ প্রিয় শহরকে একটু একটু করে গড়েছেন৷

ইংরেজ ইতিহাসবিদরা জবচার্নকের কলকাতায় আসার অর্থাৎ ১৬৯০ সালের ২৪ শে আগষ্ট দিনটিকে কলকাতার সূচনা বা গোড়াপত্তন হয় বলে গন্য করেন৷ সেই হিসাবে এই দিনটি উৎযাপন ও করা হয়৷

কিন্তু মজার বিষয় হল কলকাতা এর অনেক আগে থেকেই ছিল এমন কি কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই ছিল। তার বহু প্রমান আছে৷ যেমন —১৪৯৫ খৃষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিল্লাই রচিত "মনসামঙ্গল" কাব্যে কলিকাতার উল্লেখ আছে৷ মুকুন্দ রাম রচিত "চন্ডীমঙ্গল" কাব্যে (১৬০০খৃ), আবুল ফজলের আইনি আকবরিতে (১৫৯৬ খৃ ) কলকাতার উল্লেখ আছে ৷ (১৬৬০খৃ) Van Dan Brouke এর তৈরী ম্যাপে ও কলকাতার উল্লেখ আছে ৷ গুরু নানকের জীবনীতে জানা যায় (১৫১০খৃ) খৃষ্টাব্দে তিনি কালীক্ষেত্র দর্শন করতে এসে বহুদিন কলকাতায় বসবাস করেন৷ আইন-ই-আকবরির রাজস্ব আদায়ের খতিয়ানে (১৫৮২খৃ) কলিকাতার উল্লেখ আছে৷

প্রকৃতপক্ষে কলকাতার পত্তন ঘটে কালীঘাটের কালীমাতার অস্থিত্বের সঙ্গে অন্তসলীলা ভাগীরথীর প্রবাহের সঙ্গে৷ এক সময় এই অঞ্চলে বারো ভুঁইয়াদের দাপট ছিল। সেই বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে বিক্রমাদিত্যের অধীনে সাবর্ন বংশের দ্বাবিংশতিতম পুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মজুমদার রায় চৌধুরী (মুঘল আমলে এঁরা রায় চৌধুরী, মজুমদার উপাধী লাভ করেন) ছিলেন সরকারের রাজস্ব আদায়কারী। লক্ষ্মীকান্তের প্রপিতামহ পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন মুঘলসৈন্যের সেনাপতি৷ লক্ষ্মীকান্তের বাবা কামদেব বা জীয়া ছিলেন প্রখ্যাত পন্ডিত ও নৈয়ায়িক যিনি কালীক্ষেত্র বা কালীঘাটে তন্ত্রসাধনা করে কামদেব ব্রহ্মচারী নামে পরিচিত হন৷

পরবর্তীকালে (১৬০০-১৬৯০) লক্ষ্মীকান্তকে রাজা মানসিংহ বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে মাগুরা, খাসপুর, কলিকাতা, পাইকান ও আনোয়ারপুর এই পাঁচটি পরগনার ও হাতিয়াগড় পরগনার কতক অংশের জায়গির ও সনদ আনিয়ে দেন৷ সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার (১৬০৮) সালে তাদের জমিদারি পত্তনের সময় থেকে কলকাতার রূপ দেন। (ক্রমশঃ) 

তথ্য সূত্র —

কলকাতার ইতিবৃত্ত ( প্রাণকৃষ্ণ দত্ত)

বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা কালীক্ষেত্র কলকাতা (ভবানী রায় চৌধুরী)

ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকা

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours