সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

হামিং বার্ড পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পাখি হলেও, এরা বৃহত্তম পক্ষীগোত্র ‘Trochiladae’ র অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে মরুভূমি, পর্বত, সমভূমি সব জায়গায় পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় রেন ফরেস্টে। এই খুদে পাখিরা ওড়ার সময় খুব ঘন ঘন ডানা ঝাপটায়। অনেকগুলো পাখির সম্মিলিতভাবে ডানা ঝাপটানোর ফলে একটা তীব্র গুঞ্জন এর সৃষ্টি হয়। আর সেই জন্য এদেরকে হামিং বার্ড বলা হয়। পুরো পৃথিবীতে তিনশো থেকে চারশো প্রজাতির হামিং বার্ড রয়েছে।  

হামিং বার্ড সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত এদের উজ্জ্বল রঙের পালকের জন্য। বিশেষ করে এদের গলার কাছের পালকগুলোতে বিচিত্র রঙের নকশা দেখতে পাওয়া যায়। তবে এদের গলার ওই বিচিত্র রঙ কিন্তু পালকের সজ্জার কারণে হয় না, এটা হয় আলোর পরিমাণ, আর্দ্রতা, বা কত ডিগ্রী কোণ থেকে তাদের দেখা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। হামিং বার্ডের পালকে রামধনুর সাতটি রঙই রয়েছে। এরা উড়ে যাওয়ার সময় আলোর কারসাজির কারণে এদের গলার পালকগুলোর রঙ বদলে যেতে পারে। তবে বেশিরভাগ হামিং বার্ডের রঙই সবুজ থেকে নীলের মধ্যেই হয়ে থাকে। 

পুরুষ হামিং বার্ড তাদের আকর্ষণীয় রঙের পালক দ্বারা স্ত্রী হামিং বার্ডদের আকর্ষণ করে। কোনো কোনো প্রজাতি আবার সুর করে গান গেয়েও স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করে। তারা মিলিত হলে স্ত্রী পাখি বাসা বানায় এবং ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা দেয়। হামিংবার্ডের বাসার আয়তন একটি আখরোটের সমান। স্ত্রী হামিং বার্ড বাচ্চাদের লালনপালন করে। হামিং বার্ডের ডিম একটা জেলি বিনের চেয়েও ছোট হয়ে থাকে।নারী হামিং বার্ড তাদের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর সময় আত্মরক্ষার জন্য তার আশেপাশের পরিবেশের রঙের সাথে নিজেদের মিলিয়ে নেয়।

হামিং বার্ডকে কেবল আমেরিকার ট্রপিক্যাল অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। আকৃতিতে ছোট হলেও পৃথিবীতে যে ৩০০ থেকে ৪০০ প্রজাতির হামিংবার্ড রয়েছে তাদের মধ্যে 'কিউবান বি' প্রজাতির হামিংবার্ডটি হলো সবচেয়ে ছোট। এদের দৈর্ঘ্য মাত্র ২ ইঞ্চি অর্থাত্‍ একটা মৌমাছির সমান ফলে আপনার হাতের আঙ্গুলের ফাঁক থেকে এরা অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারে।

হামিং বার্ড হেলিকপ্টারের মতো ডান, বাম, উপর, নীচ সবদিকেই পূর্ণগতিতে উড়তে পারে। তবে একই স্থানে স্থির হয়ে থাকাটা হামিং বার্ডের একটা ট্রেডমার্ক। ওড়ায় দারুণ দক্ষ হলেও এই পাখিরা আবার হাঁটতে পারে না। এবার হয়তো ভাববেন তাহলে কি তাদের কোন পা নেই ? আছে, তবে সেই পা এতটাই ছোট যে তা দিয়ে তারা হাঁটতে পারে না বরং তা দিয়ে তাদের গা চুলকানোই হয়। এরা এক ঘণ্টায় ত্রিশ মাইলের মতো উড়তে পারে। কখনো কখনো এর চেয়েও বেশি।  

'কিউবান বি' প্রজাতির হামিংবার্ড আকৃতিতে খুবই ছোট হলেও শরত্‍ এবং বসন্তকালীন পরিযাত্রার সময় এরা মেক্সিকো উপসাগর পাড়ি দেয়। যেখানে মানুষের গড় হৃদস্পন্দন  ৬০ থেকে ১০০ বিটস প্রতি মিনিট, সেখানে হামিং বার্ডের হৃদস্পন্দনের হার ১২০০ বিটস প্রতি মিনিট! যা মানুষের চেয়ে প্রায় ১০-২০ গুণ বেশি! প্রতি মিনিটে এরা ২৫০ বার শ্বাস নেয়, ওড়ার সময় তা আরও বেড়ে যায়। এরা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৭০ বারের মতো ডানা ঝাপটাতে সক্ষম। এদের এতটাই দ্রুত চলাফেরা যে তার জন্য এদের উড়ন্ত অবস্থায় দেখলে ঝাপসা দেখায়। তবে আধুনিক ক্যামেরায় ধীর গতিতে দেখলে এদের জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

হামিংবার্ড আকারে ছোট হলে কী হবে, এদের খাদ্যগ্রহণের হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি। তারা দিনে ৩.১৪ থেকে ৭.৬ ক্যালরি খাবার খায়। সাধারণত এরা ফুলের মধু খেয়ে থাকে। লম্বা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য এদের সরু লম্বা ঠোঁটের সাথে সাথে লম্বা জিভ ও আছে। এদের জিভ প্রতি সেকেন্ডে ২০ বার স্পন্দিত হয় ফলে এরা খুব দ্রুত মধু পান করতে পারে।  এদেরকে সাধারণত মধুপায়ী মনে করা হলেও ৮৫ শতাংশ হামিং বার্ডই ফুলের মধ্যে বাস করা ছোট ছোট পোকা খায়।

হামিং বার্ড ছোট বলে এদের শত্রুর অভাব নেই। তবে এরা নানাভাবে শত্রুকে ফাঁকি দিতেও পারে। শত্রুকে ধোঁকা দিতে এরা কখনো কখনো ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নেয়, কখনো বারবার আক্রমণ করে ভয় দেখিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়। বনের শত্রুদের হাত থেকে বাঁচলেও তথাকথিত সভ্য মানুষ শত্রুদের হাত থেকে সবসময় বাঁচতে পারে না তারা। এদের সুন্দর পালকের জন্য কিছু মানুষ তাদের স্টাফ করে ঘরে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করে। মানুষের এই অদ্ভুত শখের জন্য বলি হতে হয় নিরীহ এই পাখিদের। এই সুন্দর পৃথিবীতে হামিং বার্ডের মতো সুন্দরতম সৃষ্টিরা বেঁচে থাকুক যুগ যুগ ধরে, আর এভাবেই মুগ্ধ করে যাক সকল সৌন্দর্যপিপাসুদের মন, এই কামনাই করি।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours