সন্দীপ মিত্র, ফিচার রাইটার, কলকাতা:
 
ধূসরতার বুক চিরে দৃষ্টি চলে যায় বহু দূরে। চোখের সামনে ফুটে ওঠে একটার পর একটা সাদা-কালো দৃশ্য।
বছর চারেকের এক শিশু তার বাবাকে বলে ওঠে, "বাবা খুব খিদে পেয়েছে"। অসহায়ের মতন সেই পিতা শেষবারের মতন অনর্থক তার ছেঁড়া লং কোটের পকেট হাতরালো। নাহ্ একটা কানা কড়িও নেই। উদ্ভ্রান্তের মতন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। দিক-বিদিক শূন্য হয়ে পথ চলছে মাতৃহারা শিশুর পিতা যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাস্তা দিয়ে। কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে সে জানে না। শুধু জানে একটু খাবার জোগাড় করতে হবে তার ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য।
সেদিন প্রেমিক-প্রেমিকায় স্টেশন ছিল পরিপূর্ণ। প্রেমিকদের পরণে ছিল জলপাই রঙের সেনাবাহিনীর পোশাক সঙ্গে হোল্ড-অল, যাতে লেখা রেজিমেন্টের নাম। আর তাদের হাতে অশ্রু জলে সিক্ত রুমাল। ইঞ্জিনের অনিশ্চয়তার সাদা ধোঁয়া যেন ভবিষ্যৎকে ঢেকে ফেলেছে। হয়তো ওদের শেষ দেখা, শেষ চুম্বন। প্রেমিকাদের ফেলে রেখে চলে যাবে সব প্রেমিকরা যুদ্ধের আহবানে ধ্বংসের গভীরে। ফিরলেও হয়তো কফিন বন্দি হয়ে।
১৯৪৫ এর মে মাসে ব্রিটিশ-আমেরিকা-সোভিয়েত রাশিয়ার সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ পেতে শুরু করে। ১৯৪৫ এর ৮ই মে হিটলারের জার্মানি শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে। ইউরোপ মুক্তি পায় নাৎসী জার্মানির হাত থেকে। ওই দিনটিকে 'ভি-ডে' বা ভিক্টরি-ডে বলা হয়। ওই বছরেরই ১৪ই আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে দীর্ঘ ৬ বছর (১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে ১৪ই আগস্ট ১৯৪৫) ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নাৎসী জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে আর শেষ হয় জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের গভীরে ডুব সাঁতার দিয়ে আলোচনা করবো না। তবে এইটুকু উল্লেখ করা অবশ্যই উচিত যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক বর্বরতম অধ্যায়। 
কেন এই যুদ্ধ বর্বরতম তা বলতে গেলে এক সু-দীর্ঘ পরিসংখ্যান তালিকা উল্লেখ করতে হয়, যা হয়তো এই লিপির উপযুক্ত নয়। তবে কিছু পরিসংখ্যানে আলোকপাত করলেই বোঝা যাবে বর্বরতার অসীমতা।
যুদ্ধের আগে পৃথিবীর জন সংখ্যা ছিল ২০০ কোটি। যুদ্ধে জড়িত মানুষের সংখ্যা ছিলো ১৭০ কোটি। সরকারী ভাবে যুদ্ধে যোগ দিয়ে ছিলো ৭২টি দেশ। ১১ কোটি মানুষ যুদ্ধে যোগদান করে ছিলো এবং নিহত হয়েছিল ৫ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ। সামগ্রিক ভাবে ৮ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ সোভিয়েত সেনা, ৩২ লক্ষ ৫০ হাজার জার্মান সেনা, ১২ লক্ষ ৭০ হাজার জাপানী সেনা, ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ব্রিটিশ সেনা, ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৬৮ জন ফরাসী সেনা, ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৪৯৬ জন ইতালীয় সেনা প্রাণ হারায়।

যুদ্ধে বিশাল সংখ্যক 'সিভিল ক্যাজুয়ালটি' বা অসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যা নৃশংসতার চরম ছবি ফুটে ওঠে বাস্তবে। সিভিল ক্যাজুয়ালটির বড় উদাহরণ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৪৫-এ জাপানের হিরোশিমা (৬ই আগস্ট) ও নাগাশাকিতে (৯ই আগস্ট) আমেরিকার পারমাণবিক বোমা বর্ষণ। যার ফলস্বরূপ লক্ষাধিক জাপানির মৃত্যু হয়, অসংখ্য জীবিত মানুষকে গ্রাস করে পঙ্গুত্ব এবং এদের মধ্যে বেশির ভাগই সাধারণ নাগরিক। উল্লেখযোগ্য হল এরপরই মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও তা ম্লান করে বিশ্বের কাছে ত্রাস সৃষ্টি করে আধুনিক রাক্ষুসে যুদ্ধাস্ত্র 'অ্যাটম বোমা'।
যুদ্ধ চলা কালীন ও শেষে লক্ষাধিক মানুষ দেশ ছাড়া, পবিবার বা পরিচয় হারা হয়ে পড়ে। এদের নাম দেওয়া হয় 'ডিসপ্লেসড পার্সন' বা 'ডিপি'। শুধু মাত্র নতুন রাষ্ট্র চেক থেকেই ৩০ লক্ষ ও পোল্যান্ড থেকে ১৫ লক্ষ জার্মানকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনাথ শিশু ও নির্যাতিতা-ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা হিসেবের বাইরে।
ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের ৪০টি দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। প্রত্যেকটি মানুষ কোনো না কোনো ভাবে যুদ্ধে লড়াই করেছে এবং তাদের জীবনে ছাপ ফেলেছে। এমন কি পরাধীন ভারতের বাংলাও বাদ পড়েনি, তার প্রমান ৪০-৫০ লক্ষ মানুষের দুর্ভিক্ষে মৃত্যু।
যুদ্ধের পর জয়ী সেনারা আবিষ্কার করেছে ধ্বংস আর আবর্জনার স্তূপকার। ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া বা পুড়ে যাওয়া বাড়ি, চূর্ণ-বিচূর্ণ সেতু, রেল পথ, রাস্তা। আস্ত প্রায় কিছুই নেই। এলাকা জুড়ে মৃত্যুর হাহাকার। খাবার নেই, প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই, স্কুল নেই, পড়াশোনা নেই, ব্যাংক নেই, দোকান নেই, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নেই, নেই কোনো আইন শৃঙ্খলা। আছে শুধু ধ্বংস স্তুপের আনাচে কানাচে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, লুঠ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নির্যাতন-ধর্ষণ আর নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে দু-মুঠো অন্নের জন্য মৃত্যুর সাথে জীবনের লড়াই। 
ক্ষয় ক্ষতির এই সব হিসাব ও তথ্য যে সম্পূর্ণ তা বলা চলে না। কারণ যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা থেকে একদম সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যে দুঃসাধ্য তা বলাইবাহুল্য। এ ছাড়া মানুষের জীবনে যে ছাপ ফেলেছিল তা কি শুধু সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায়? যুদ্ধ অবসানের ৩০ বছর পরেও দারিদ্র, বেকারত্ব, উদ্বাস্তু, মুদ্রাস্ফীতি এবং যুদ্ধের দ্বারা ব্যাধির ছাপ তখনও স্পষ্ট।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তির ও ফ্যাসিবাদের পরাজয় ও মিত্রশক্তির জয় তা বিশ্বের কাছে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় অনেকটাই। তার কারণ শেষ পর্যন্ত পরাজয় হয়েছিল সমগ্র মানবতার। সেই সময়কালে পৃথিবীর মহান চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের চরম আপত্তি, বিরোধিতা, প্রতিবাদও যা রোধ করতে পারেনি।
মানুষই গড়ে আবার সেই মানুষই ধ্বংস করে। আর ধ্বংসের পর নতুন করে গড়ে তোলা ছিলো এক অসম্ভব কাজ। এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে মানুষ আরো আধুনিক। এখনও যখন দেখি বিভিন্ন শক্তিধর দেশের রণংদেহী মূর্তি তখন শিহরিত হই। কারণ তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হলে পৃথিবীতে ছাই ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকবে না। তাই মানবতাই রক্ষা করতে পারে মানবতা ও তার সভ্যতা আর কিছু নয়।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: 'দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস'- বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়।)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours