ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

শখ করে বাগানে ফলের গাছ লাগানো হলো। একসময় দেখা গেল সেই গাছে ফুল থেকে ফল ধরেছে। তারও কিছুদিন পর লক্ষ্য করলেন ফল পরিপক্ক হওয়ার আগেই ঝরে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কৃষি বিশেষজ্ঞ আপনাকে পরামর্শ দেবেন গাছের গোড়ায় পুষ্টির অভাব হয়েছে। মনুষ্য সমাজও অনেকাংশে একপ্রকার। আমাদের সমাজে যখন কোন অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন আমরা সেই বিষয়ে কথা বলি। তার বিচার চাই। কিন্তু কখনোই খতিয়ে দেখি না, আসলে এর মূল সমস্যা কি? কোন উপায়ে এর সমাধান আসতে পারে।

বর্তমান সময়টা ধর্ষণ শব্দের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একটি ঘটনা, রটনা হতে না হতেই, ঠিক একই কারণে দুষ্ট অন্য একটি ঘটনার সংবাদ হচ্ছে। ধর্ষণ নিয়ে অনেকের মতান্তর রয়েছে। কেউ বলছেন, ধর্ষনের জন্য মেয়েরাই দায়ী। আবার কেউ বলছেন কিছু উৎশৃঙ্খল ছেলেরা দায়ী। কেউ বলছে বাবা-মা দায়ী। কেউ বলছেন আধুনিক যুগ দায়ী। আসলে কে দায়ী? এর সঠিক সমাধানে এখনো আমরা আসতে পারিনি। আমি মনে করি, অন্যায় কখনো একা আসে না। সে নিজের সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে আসে। যেমন অন্যায় ভাবে যদি কারো কাছে টাকা আসে। তখন তিনি নিজেকে নিরাপত্তা দিতে একটি অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করবেন। অর্থ এবং অস্ত্র যখন তাঁর কাছে আসবে তখন তিনি অবশ্যই আনন্দ-ফুর্তি করতে মাদক সংগ্রহ বা সেবন করবেন। অর্থ, অস্ত্র এবং মাদক তিনটি অবৈধ শক্তি ব্যক্তিকে তখন যৌনাচারে আগ্রহী করে তুলবে। যৌনাচার দুইভাবে হয়ে থাকে। একটি সুষ্ঠ সমাধানে, অন্যটি জোরপূর্বক। সুষ্ঠ সমাধান বলতে আমরা বুঝি অর্থের বা কাজের বিনিময়ে। অন্যটি হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি তখন নিজেকে পরাশক্তির অধিকারী মনে করেন। তাই সমাজে নিজেকে যাচাই করতে অন্যায় ভাবে তুলে এনে বা জোর করে যৌনাচারে লিপ্ত হয়। যৌনপরাক্রমশালী ব্যক্তি নিজেকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মনে করতে থাকে। আমরা যদি মনে করি, ধর্ষক তার যৌন লালসা মেটাতে ধর্ষণ করে, তাহলে ভুল করা হবে। কারণ ধর্ষণ এবং যৌনমিলন দুটি ভিন্ন বিষয়। ধর্ষণ হচ্ছে একপ্রকার বিকারগ্রস্থ মানুষের জয়ী হওয়ার চেষ্টা মাত্র। তারা মনে করে, কোন নারীর যৌনাঙ্গ স্পর্শ করতে পারাটাই হলো পৌরুষত্বের বিজয়। তাই বিকারগ্রস্থ ব্যক্তি অবৈধভাবে নারীর যৌনাঙ্গ স্পর্শ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ধর্ষণের মতো ঘটনার জন্ম হয়। কখনো কখনো দেখা যায় ধর্ষক হয়তো প্রথম জীবনে কোন নারীর কাছে প্রতারিত হয়েছে। এক নারীর প্রতি প্রতিশোধ নিতে, অনেক নারীকে ধর্ষন করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে। আবার কেউ জীবনে কখনো না কখনো প্রতারিত হয়েছে। সেই বিষয়ে মানষিক অবসাদ তাকে ধর্ষক হতে বাধ্য করে। আবার অনেক সময় সমাজের প্রচলিত নিয়মগুলি কারো কাছে অনিয়ম হিসাবে মনে হতে পারে। এসব অনিয়মের প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে ধর্ষণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সব সময় যে ধর্ষক অন্যের প্রতি বিদ্বেষের কারণে করে থাকে তা নয়। হতে পারে, তার বাবা দিনের পর দিন অন্যায় করছে। ছেলেটি তা সহ্য করতে পারছে না বা প্রতিবাদ করতে পারছে না। তখন মনের মধ্যে পুষে রাখা রাগ, ক্ষোভ থেকেও ধর্ষণ করতে পারে।  ঠিক তেমনি মা, বোন, ভাই বা যে কোন আপনজনের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করতে পারার যন্ত্রনা থেকেও ধর্ষণ করতে পারে।

আবার যদি বলি, যে পরিমানে সমাজে ধর্ষণ হচ্ছে, প্রতিবাদ সেই পরিমানে হচ্ছে না। এ বিষয়ে একটা কথা বলতে চাই, তা হলো ধর্ষণ কি শুধু অসভ্য ব্যক্তির দ্বারা হচ্ছে? মোটেই তা নয়। বরং ভদ্র সমাজে বেশি ধর্ষণ হচ্ছে। তবে তা চার দেওয়ালের বাইরে আসে না। ধর্ষিতার বুক ফাটা হাহাকার কেবল বাথরুমের বদ্ধ ঘরেই আটকে থাকে। সমাজে ভদ্র, সভ্য ধর্ষণ হচ্ছে ৮০ শতাংশ। সকলেই চুপচাপ মেনে নিচ্ছে। অবিবাহিতরা বিয়ের জন্য বা পরিবারের সুনামের জন্য। বিবাহিতরা সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য। ধর্ষণের প্রতিবাদে সামিল হতে গিয়েও ধর্ষণ হচ্ছে। অথবা যার সাহায্যে ধর্ষণের প্রতিবাদে আওয়াজ তুলছেন কখনও যে তিনিও কৌশলে ধর্ষণ করছেন। সব ক্ষেত্রেই যে মিথ্যা  বা ধোকা দিয়ে ধর্ষণ করছে তা কিন্তু নয়। অনেক সময়, পুরুষ একটি স্বপ্ন ছুঁড়ে দিলো মেয়েটির সামনে। মেয়েটি তা লুফে নিলো। তারপর দুজনে একসঙ্গে শরীর ভাগাভাগি করল। একসময় মেয়েটি দেখতে পেলো, পুরুষটি তাকে যে স্বপ্নের কথা বলেছে তা মিথ্যা। তখন মেয়েটি প্রতিবাদ করলো ধর্ষণ শব্দটির দ্বারা। এ ঘটনা নেহাৎ কম নয়।

জোরপূর্বক ধর্ষণ হওয়ার পর কেউ হয়তো আইনের আশ্রয় নিলেন। অতঃপর শুরু হলো ধর্ষিতার উপর পুনরায় ধর্ষণ। ধর্ষিতা মেয়েটিকে প্রথমবার জোরপূর্বক ধর্ষন করা হলেও পরবর্তীতে কয়েকবার স্বেচ্ছায় ধর্ষিতা হতে হয়। স্যাম্পল সংগ্রহের নামে ডাক্তার, প্রমাণ স্বচক্ষে দেখার জন্য আইনজীবি, সাক্ষ্য দেবার জন্য আরো কয়েকজন। এরপর ধর্ষিতার পক্ষে থাকা আইনজীবি তাঁর নোংরা শব্দের মাধ্যমে ধর্ষিতা মেয়েটির বিভিন্ন অঙ্গের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তারপর প্রকাশ্য আদালতে মেয়েটির সামনে, সেই সব নোংরা বিবরণ উচ্চস্বরে বয়ান করতে থাকেন। এত বার ধর্ষণ হওয়ার ভয়ে অধিকাংশ মেয়ে আদালতের স্বরণাপন্ন হয় না। এসব জানার পরও কি কোন মেয়ে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড চেয়ে আদালতের স্মরণাপন্ন হবেন, নাকি নিজের মৃত্যুদন্ড কামনা করবেন !

৮ অক্টোবর বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। সংবিধানে আইন প্রণয়ন হয়। যতক্ষণ না সেই আইন বাস্তবায়ন না হবে ততক্ষণ সে আইন মৃত। মৃত্যুদন্ড এবারই নতুন নয়। কাউকে খুন করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাই বলে কি দেশে খুন হচ্ছে না? দরকার আইনের যথাযথ প্রণয়ন। তবে ধর্ষণ আইনের সংশোধন না হলে, ধর্ষিতারা আইনের আশ্রয়ে যেতে আগ্রহী হবে না। আর সেই সুযোগে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন কার্যকর করা সম্ভব হবে না এবং ধর্ষন বন্ধ করাও সম্ভব হবে না।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours