সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:

সারাবছর অপেক্ষায় রেখে মা আসেন... 

অধীর আগ্রহে আমরাও শরতের শিউলি  ফোটার আর ভোরের শিশিরের অপেক্ষায় বসে থাকি। আসলে পুজো তো শুধু মাতৃবন্দনা নয়, পুজো হল সব চাওয়া পাওয়া, আশা আকাঙ্ক্ষা, পাওনা, প্রাপ্তির এক লম্বা তালিকা। 

মনে পড়ে আশির দশকে ছোটবেলায় চুলের ক্লিপ থেকে পায়ের নেলপালিশ পযর্ন্ত  জামার রঙের সাথে মিলিয়ে কেনাকাটা। রঙ মিলিয়ে কেনাটাই ছিল নিয়ম। তা বলে চাইলেই যে পাওয়া যেত তা কিন্তু নয় বেশ বায়নাক্কা করে তবে হত প্রাপ্তি। অনেক কাতর অনুনয়ের পর পাহাড় যেন একটু হেলে উঠল। অর্থাৎ মা বা বাবা রাজি হতেন। সে সেময় মধ‍্যবিত্ত মানসিকতায় অকারণ কেনাকাটা ব‍্যাপারটা রুদ্ধ সঙ্গীতের মত। তখন শাসন ব‍্যাপারটা যথেষ্টই কড়া ছিল। আর ছিল না অনলাইনে কেনাকাটা করার সহজলভ‍্য উপায়। অনলাইনে কেনাকাটা হল চিররুগ্ন অর্থনৈতিক  ব‍্যবস্থায়  ধনতান্ত্রিক ছোঁয়া। রঙের প্রলেপ দেওয়া আরকি।

সেসময় পুজোর ছুটি ফুরোলেই বার্ষিক পরীক্ষা, সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং যেন পূর্ণগ্রাস লোডশেডিং। আশপাশের মাঠ থেকে প‍্যান্ডেল তৈরির খুটখাট আওয়াজ। তারই মধ‍্যে বাচ্চাদের পড়াশোনা করতে হত। বই খোলা। অথচ মন যেন উদাস। হ‍্যারিকেনের কম আলোয় পড়তে পড়তে হত নানা পরিকল্পনা। পড়া পড়া ভাব। আসলে তো পড়া ঠিকঠাক হত না। ষষ্ঠীতে কোন জামা পড়বে? তারপর কোনটা সপ্তমীতে? তারপর হাতে কত টাকা এল? পুজোর হাতখরচা বাবদ কিছু পয়সাকড়ি (এ যুগের নিরিখে যৎসামান্য) তখন হাতে আসত মামা বা কাকারা দিতেন। অষ্টমীতে সবচেয়ে ভাল জামাটা পড়তে হবে এটাই দস্তুর। ভাল জামার সংজ্ঞাটা যে ঠিক কি আজ অব্দি তা জানতে পারলাম না। বাড়ির সাহায‍্যকারী মাসির মেয়েটা একখানা ছিটের জামাটা অষ্টমীতে পড়ত। ওর ছিল ওইটাই শ্রেষ্ঠ জামা। তা যা বলছিলাম পরীক্ষার প্রস্তুতি না পুজোর প্রস্তুতি প্রাধান্যটা যে কাকে ছেড়ে কাকে দেবে খুব দ্বন্দ্বে পড়ে যেত সেই সময়ের কিশোর কিশোরীরা। ওদের চোখ তখন বইয়ের খোলা পাতায়, মন নতুন জামায়, কান প‍্যান্ডেলের আওয়াজে, নাকে নিমকি ভাজার গন্ধ অথবা নাড়ুর গন্ধ, জিভে জল, আর ত্বক গরমে ঘামে ভিজে। এই ছিল পঞ্চেন্দ্রীয়র করুণ অবস্থা।

তারপর মায়েদের অমায়িক সুমিষ্ট সুচিৎকার গলায় "কিরে গলার আওয়াজ নেই কেন? আর তো কদিন বাদ পরীক্ষা, পড় মন দিয়ে। নইলে ঠাকুর দেখা বন্ধ।" নিমেষে যেন সব অন্ধকার। আবার পড়ায় মন দেবার চেষ্টা চলত। এই ছিল  সে সময়ে মধ‍্যবিত্ত পরিবারে পুজোর প্রস্তুতি। মাঝে মাঝে ঠাকুমা বা দিদিমার আদরের আস্কারা তো ছিলই। নাড়ু পাক দেওয়ার সময় বা নিমকি ভাজার সময় মিষ্টি ডাক (উৎকর্ণ হয়েই থাকত তারা) "কুচো নিমকি নিয়া যা,... রসকরা একখান্ কইরা খা এখন, ঠান্ডা হউক তারপর আরও খাইস্।" এই ছিল পুজোর নির্মল আনন্দের বাতাবরণ। জৌলুস ছিল না ছিল মনের আন্তরিকতা আর পরিবারের স্নেহের বাঁধন।  

এখনকার পুজোয় ছেলেমেয়েদের আনন্দ, খুশি ইত্যাদি যুগের সাথে পরিবর্তিত। তুলনায় যাচ্ছি না। আমার মনে হয় এযুগের ছেলেপিলেরা অনেক অনাবিল আনন্দের স্বাদ থেকে বঞ্চিত। এজন‍্য আমরাই কি দায়ী নই? এখন কজন মা পারেন তাদের ব‍্যস্ত সময় বাঁচিয়ে নারকেল কুড়তে? বা ধৈর্য্য নিয়ে দুধ শুকিয়ে ক্ষীর বানতে?নিমকি, গজা এসব বানানো তো অতি দূরের কথা। অবশ‍্য অনেকেই আজকাল এসব বানিয়ে সোস‍্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন রান্নার গ্রুপে পোষ্ট করেন, তথাপি বলব এযুগের ছেলেপিলেরা পুজোর নাড়ু (নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, ছাতুর নাড়ু আরও কত কি) মোয়া, কুচো নিমকি, গজা ইত্যাদির রসনা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আমাদের  মায়ের কাছে আজও পুজো মানে মা ষষ্ঠীর পুজো, অষ্টমীর অঞ্জলী, সন্ধিপুজো, একশ আটটা পদ্ম, প্রদীপ ধুনোর গন্ধ, নাড়ু, মোয়া, গজা, নিমকি। তারপর শুভবিজয়ায় নিজ হাতে লেখা চিঠি। 

আজ চিঠি অতীত, এবছর করোনার গ্রাসে মায়েদের অঞ্জলী নেই, ঠাকুর দেখা নেই, সন্ধিপুজোয় উপস্থিতি নেই। কিন্তু আজও আছে নিজ হাতে বানানো নারকেল নাড়ু, রসকরা, পদ্মচিনি (নারকেলের মিষ্টি), চন্দ্রপুলি, তিলের তক্তি, এলেঝেলে (গজা) কুচো নিমকি। 

করনো আবহে এবছর মায়ের মুখ কি দেখব না--করুণ আর্তি বৃদ্ধা মায়েদের। অনেক বুঝিয়েও  কিছু হয় না,  মন খারাপ চোখে জল, ছেলেমেয়েদের ওপর অভিমান জমে ওঠে। কিন্তু মুখে রা কাটেন না। 

শেষপর্যন্ত সেই ক্লিপ কেনার বায়না ধরা মেয়েটা বা ক‍্যাপ বন্দুক কেনা বায়না ধরার ছেলেটা আজ মধ‍্যবয়সীরা সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণা মেয়ের বা প্রবীণ ছেলের বায়না মেটাতে নিয়ে যান ঠাকুর দেখাতে।

এভাবেই বোধহয় সময় সংসারের ঘুর্ণীপাকে আর্বতিত হতে থাকে। বিশ্বায়নের যুগে এই স্নেহ, ভালবাসা বেঁচে থাক চিরকাল। 

ছবি সৌজন্যে: প্রতিবেদক

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours