কাকলি সেনগুপ্ত, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

দিন দুয়েক আগেকার কথা।  খবরের কাগজ বিলি করে চলে গেছে, কলেজের ছাত্র অরিন্দম। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে, বাড়তি কিছু  রোজগারের আশায় এই কাজটা করে।  কাগজ  তিনটে  দরজা দিয়ে ছূঁড়ে ফেলে দেয় ও।  আমি সময়মত কুড়িয়ে নিই। সেদিন কাগজ হাতে নিয়ে দেখলাম  প্রখ্যাত ফুটবলার তুলসিদাস বলরামের ছবি। চুণী, মানে চুণী গোস্বামী ও পি.কে. ব্যানার্জীর  কথা মনে করে  জন্মদিনে বিষণ্ণ তিনি। তুলসিদাস বলরামের ছবি দেখে  আমি একটানে পিছিয়ে গেলাম অনেকগুলো বছর। সেই ১৯৮৯ সাল। দশক ভেদে দর্শকের  মানসিকতা বদলায় কিনা তা জানতে বসে পড়া গেল, ওঁদের সামনে। ওঁরা বলতে সুশান্ত ঘোষ,  সনৎ শেঠ,  পি কে ব্যানার্জী,  তুলসিদাস বলরাম,  অরুণ ঘোষ,  পি বর্মণ,  সুশীল সিনহা ও শ্যাম থাপা।  তাঁদের সময়ে তাঁরা গ্যালারি দেখেছেন মাঠ থেকে। দর্শকের  সঙ্গে তখন ছিল, এক ধরণের সসম্ভ্রম  দূরত্ব। খেলোয়াড় হিসেবে অবসর নেবার পর তাঁরা কেউ কোচ, কেউ নির্বাচক। আবার কেউ বা মাঠে যান এখনও, খেলাকে ভালোবেসে। কী চোখে দেখেন তাঁরা, দর্শকদের?  সময়ের সঙ্গে দর্শকেরও মন বা মান বদলেছে বা বদলায় কী? এই নিয়ে বাইশের আমি রীতিমতো বড়োদের সঙ্গে আড্ডায়  বসে যেতাম । অল্প বয়সে যা হয় আরকি। 

  ফুটবল নিয়ে এই আগ্রহ আমার সময়ে খুব সহজ কিছু ছিল না। বেঙ্গল পটারি সিক হতে শুরু করলে  বেলেঘাটার  বাসাবাড়ি  থেকে রহড়ায় ফিরে এলাম আমরা। বাবা বলতেন, কেউ ঠিকানা জানতে চাইলে বলবে, আমাদের বাড়ি রহড়ায়। বেলেঘাটায় বাসা। বাড়িতে, মানে পার্মানেন্ট অ্যাড্রেসে থিতু হবার পর, আমার জীবনে এল সেই চামড়ার গোলক। ফুটবল। বাবার সঙ্গে মাঠে যাওয়া শুরু হল আমার। যেখানে রহড়া সঙ্ঘের খেলা, সেখানেই বাবার পাশে আমার পুঁচকি ছায়া। তাই তুষার পণ্ডিত যখন ‘টপিক’ বলতে বললেন, আমি ধাঁ করে বলে দিলাম ‘ফুটবল’। তারপর,  ফুটবল এবং দর্শক এই নিয়ে  বসে গেলাম ওঁদের মুখোমুখি। 

কথায় কথায় উঠে আসা মণি মুক্তোর সবটা প্রাসঙ্গিক ছিল না সেই দর্শকের দর্শক প্রতিবেদনে। তার কিছু এখনও উজ্জ্বাল আমার স্মৃতির অলিন্দে, কিছু বা  বিস্মৃতির এখতিয়ারে। থেকে যাওয়া কথা থেকে বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে তুলসিদাস বলরামের এক আক্ষেপের কাহিনি। একবার এক সম্ভাবনা নিয়ে সরগরম কলকাতা ময়দান। সেরা খেলোয়াড়ের শিরোপা বোধহয় বলরামই পাবেন। উনিও সবার মতোই প্রতীক্ষায়। কিন্তু মরশুমের শেষে দেখা গেল যে, গুঞ্জনে জল ঢেলে সেরার সম্মান পেয়েছেন অন্য কেউ। নিজের ত্রুটি খুঁজতে গিয়ে জানলেন, তিনি একদিন দু-হাত ছড়িয়ে রেফারির দিকে তাকিয়েছিলেন। লজ্জিত হয়েছিলেন তিনি। বললেন, পরের বছর আর রেফারির দিকে তাকাই-ইনি বুঝলে? সেই সময়ে মাঠের সঙ্গে মাঠের বাইরের আচরণ নিয়েও ভাবতেন তাঁরা।  

 ফুটবলের কারণেই জাপানে যেতে হয়েছিল তাঁকে। কথায় কথায় বলছেন, আমি একটা জায়গায় এক ভদ্রলোকের জন্য অপেক্ষা করছি। একটা  সময়ে রাস্তা থেকে ছোটো ছোটো পাথরের টূকরো তুলে নিয়ে রাস্তাতেই আস্তে আস্তে ফেলতে শুরু করলাম। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে সামনের বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে একবার রাস্তার আলোর দিকে দেখাল, একবার আমার হাতে ধরা পাথরের দিকে দেখাল। বলল, ব্রেক। আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। দুঃখ প্রকাশ করলাম। 

  সাম্প্রতিক সময়ে দাঁড়িয়ে এই সৌজন্যবোধ অল্প-শ্রুত গানের মতো। বলা যায় ওনারস প্রাইড। আহা এমন যদি হয়, আবারও ফিরে এল সেই সহিষ্ণুতা ও সৌজন্যের এমন মোহন  অনুশীলন। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours