সঞ্জয় সরকার, ফিচার রাইটার ও সাংবাদিক, বাঁকুড়া:

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়লেই বড় বাড়ির মানুষদের মন উচাটন হয়ে থাকে বাড়ির উমার জন্য। আবার যে এসেছে শরতকাল আর শরৎকাল মানেই কাশের বনে হাওয়ার দোল আর নীল আকাশে পেঁজা তুলোর ভেলা। ঠিক তখন থেকেই বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে হদলনারায়ণপুর বড়বাড়ির মানুষদের মন ছুটে যায় বাড়ির নাটমন্দিরে সারাবছর কাঠামো হয়ে পড়ে থাকা মায়ের পূর্ণ অঙ্গ দেখার জন্য। এখন থেকেই তো শুরু হবে মায়ের অঙ্গরাগ। তাঁদের বারে বারেই চোখ চলে যায় বাড়ির সিংহ দুয়ারে বহুদিন না দেখা কাছের মানুষদের দেখার জন্য। জমিদার বাড়ির উত্তরপুরুষরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন দেশে বিদেশের নানা প্রান্তে। কিন্তু বাড়ির পুজোর টানে সবাই হাজির হন পিতৃপুরুষের এই জমিদার বাড়িতে। পুজোর কয়েকটা দিন বাড়ির ৫০০ সদস্যর মুখ দেখাদেখি। সমবয়সীদের জমাটি আড্ডায় দুনগুলি ফুরিয়ে যায় নিমেষে। এর পর আবার সাতমহলা বাড়ির স্মৃতি আঁকড়ে ফিরে যাওয়ার পালা। ফিরে দেখার অপেক্ষা আবারও এক বছরের।

হদলনারায়ণপুর জমিদার বাড়ির তিনশো বছরের আভিজাত্যর এখনও খামতি নেই এতটুকু। অতিবিশাল ভিতর বাড়ির নাটমন্দিরে মূর্তি গড়া শুরু হয়েছে। সাজানো হয়েছে সাতমহলা জমিদার মহলের বাইরে সুদৃশ্য টেরাকোটার রাম মন্দিরও। অতীতে যেমন নিয়ম এবং রীতিরেওয়াজ মেনে দেবী পুজোর আয়োজন হত, এখনও তাই হয়। পুজোর ক’দিন দেবীর মাথায় চড়ে ৩০ ভরি সোনার মুকুট। অঙ্গে থাকে আরও সোনার অলংকার। এ সবই সেই সাবেক কালে জমিদারির নিদর্শন।  

জমিদারি গিয়েছে বহুকাল। কিন্তু মল্লরাজাদের খাসতালুক হদলনারায়ণপুরের জমিদার এই মন্ডলবাড়ির চেহারায় কৌলিন্য হারায়নি এতটুকু। বাড়ির দুর্গাদালান ছাড়াও কুলদেবতা রাধাদামোদর, মহাদেব মন্দির, রাসমঞ্চ ও নিজস্ব পুকুর নিয়ে একটি সম্পূর্ণ বনেদিয়ানা এখনও ধরে রেখেছেন জমিদার মুচিরাম ঘোষের উত্তরপুরুষরা। দুর্গা মন্দিরের ভিতর বাড়িতে মণ্ডল পরিবারের বাস। পুজোয় সেখানেই চলে রান্নার আয়োজন। বর্তমানে পরিবারের অনেকই চলে গেছেন প্রবাসে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সাগর পেড়িয়েও। সেই শাখা-প্রশাখা ছড়ানো মন্ডল পরিবারের সদস্যদের মন এখও উচাটন হয়ে থাকে পিতৃপুরুষের সাবেকি বাড়ির পুজোর জন্য। নবীন প্রজন্ম যারা নিজেদের জমিদারির গল্প শুনেছে বাপ-ঠাকুর্দার কাছে তাঁরাও বছরে একটি বার এসে ঘুরে বেড়ায় পূর্বপুরুষের তৈরি করে যাওয়া কাছারি বাড়ি থেকে জলসাঘরে। প্রবীণদের কাছে শুনে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে জমিদারির আদপকায়দা। তাঁরা কেবলি ছুটে যায় বড় বাড়ির ছাদে নহবতখানায়। হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে একচালা দুর্গার মাথায় ৩০ ভরি সোনার মুকুটের দিকে। শহুরে চাকচিক্য ভুলে ঠিক যেন এক স্বপ্নেমহলে এসে পড়েছে তাঁরা।   

দুর্গামন্দির, আটচালা, কাছারি বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে প্রবীণ মানুষগুলি শোনালেন তিনশো বছরের জমিদারির কাহিনি। জানালেন বাড়ির পুজোর রীতি রেওয়াজ। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা গোপাল সিংহ দেবের আমলে (১৭১২-১৭৪৮) পাত্রসায়রের এই নারায়ণপুরে আসেন বর্ধমান মহারাজার দেওয়ান মুচিরাম ঘোষ। সেখানেই পরিচয় হয় প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর রায়ের সঙ্গে। গণিত শাস্ত্রে সরল এক পন্থা এনেছিলেন শুভঙ্কর। মুচিরাম মল্লরাজা গোপাল সিংহ দেবকে সেই সহজ গণিত শিখিয়েছিলেন। তখন থেকেই মল্লরাজের নেকনজরে পড়েন মুচিরাম। এর পর, গোপাল সিংহর কাছে ‘মন্ডল’ উপাধি পাওয়ার সঙ্গেই পেয়ে যান পাশাপাশি দুই গ্রাম হদল ও নারায়ণপুর সহ বেশ কিছু পরগনার জমিদারি। সেই থেকেই শুরু বাড়ির দুর্গাপুজো। জমিদারি আমলে মহালয়ার দিন থেকেই নগরবাসীর ঘুম ভাঙত নহবতের সুরে। শুরু হত উমার পুজোর আয়োজন। তিন শতাব্দী পেড়িয়ে আজও পূর্বপুরুষের পুজোর সেই রীতি ধরে রেখেছেন মন্ডল বাড়ির বর্তমান সদস্যরা। শুধু থেমে গেছে নহবতের সুর। বছর চারেক ধরে আর নহবত বসছে না। তবে বাকি সব রীতি রেওয়াজ পূর্বপুরুষের নিয়মেই চলছে। 

মন্ডল বাড়ির সিংহদুয়ার পেড়িয়ে ভিতরে ঢুকতেই নজর কাড়ে টেরাকোটার রামমন্দিরটি। ভিতর বাড়ির দুর্গামন্দিরে নজর আটকায় সুদৃশ্য পালকিটিতে। সপ্তমীর সকালে ওই পালকিতে চড়িয়ে বাড়ির মহিলা পুরুষরা বাদ্য বাদক সহ কাছের বোদাই নদীর ঘাট থেকে নবপত্রিকা বরণ করে নিয়ে আসেন। আবার পালকিতে চড়েই দশমীর দিন নবপত্রিকা ওই বোদাই নদীতেই বিসর্জন দেওয়া হয়। জমিদার বাড়ির সাবেকি প্রথা অনুযায়ী দেবীমূর্তি গায়ে গঙ্গামাটির প্রলেপ পড়ে জন্মাষ্টমীর দিন। এর পর আস্তে আস্তে শুরু হয় মূর্তি গড়া। আর ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় বড়বাড়ির ঝাড়পোছ। নাটমন্দির থেকে আটচালায় বছরভর নিশ্চিন্তে আশ্রয় নেওয়া পায়রাগুলি তখন ভীষণ বিরক্ত। তাদের ডানা ঝটপটে যেন ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই রব। সেখানে যে তখন রঙের প্রলেপ পড়ছে। নিশ্চিন্ত আশ্রয় হারিয়ে পারাবতরা গিয়ে বসে সতেরো চূড়ার রাসমঞ্চর ঘুলঘুলিতে। ভাড়ার ঘরে ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে বের করা হয় পুজোর বাসনপত্র। আর তো মাঝে কয়েকটা দিন। জমিদারবাড়ির ঐতিহ্য বিরাট সব বাসনে পরিবারের পাঁচশো সদস্যর রান্না চড়বে। বাড়িতেই বসবে ‘ভিয়েন’। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে তৈরি হবে চোদ্দ পদের মিষ্টি। তার সঙ্গে ৫২ পদের নাড়ু। এটাই সাবেক কালের রীতি। 

প্রাচীন এইসব ধারাবাহিকতা আজও অটুট। জমিদার বাড়ির পুজো কি শুধু পুজোতেই থেমে থাকে? বাড়ির ছেলেরা প্রতিবার পুজোয় সপ্তমীর রাতে যাত্রার আসর বসায়। নবমীর রাতে থাকে জলসার আয়োজন।

হদলনারায়ণপুরের জমিদার বাড়ির পুজোকে ঘিরে মেতে ওঠেন গ্রামের মানুষও। ৪৫ ভরি সোনার ভূষণে সজ্জিতা দেবী দর্শনে আসেন আশপাশের গাঁয়ের মানুষও। বাড়ির দেবীর নিজস্ব আয়ের সম্পত্তি রয়েছে ৫০০ বিঘা ধান জমি। এছাড়া রয়েছে মাছ চাষের পুকুর। তাই উমা প্রতি শরদীয়ায় নিজের পুজোর খরচ নিজেই যুগিয়ে রাখেন। তবে এবার করোনা আবহে বাড়ির অনেকেই আর বাড়ির পুজোয় আসতে পারছেন না। তাই বড় বাড়ির নাটমন্দিরে মায়ের আরাধনা হলেও পুজোকে ঘিরে কচিকাঁচাদের হুটোপুটি আর বড়দের জমিয়ে আড্ডা মারার চেনা চিত্র এবার দেখা যাবে না। তাই মন ভালো নেই বাড়ির। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours