দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

   ট্রামলাইনের পাশ থেকে, কিংবা বাসস্ট্যান্ডের একপেশে - জীবন যেমনই হোক, 'বিরি.....' সম্পূর্ণ নাম উচ্চারণের ও দরকার পরে না। 

   সুদীর্ঘকালীন সময় ধরে এমনি মহিমান্বিত বস্তুটির জন্য ভিখিরিমাফিক নিকিরিপনা করে আসছিলুম। অনেকের মনে হতে পারে, "হেঃ,‌ এ আর এমন কি, রোজই তো পাতে পড়ে"। তা এজ্ঞে আপনারা রাজার ব্যাটা, আমি কেরাসিনতেলওলা করোনার তিলে ঢ্যামনামির হিপনোটিজম আমার বাড়িকে ভালোই ঘোল খাইয়েছে। অতএব বাইরের খাবার...নৈবঃ নৈবঃ চ। 

   কিন্তু গরীবের প্রাণের ব্যাথা ভগবানের বুকেও তো বাজে! আজ তাই ভদ্রলোক আমার গরীব মাথায় হাত রেখেছেন - "যা বেটা, জি লে আপনি জিন্দেগী"

   লোভী বামুনে স্বভাবজাত হলেও পুরো প্লেট একবারে সাবাড় হয়নে আমার পাকস্থলী দ্বারা। অতএব ব্যাঘ্রনুসরণকারী হয়ে এট্টু এট্টু করেই...

   তো এই ঝিমধরাসন্ধ্যায় স্বর্গের স্বাদ লালারসে আস্বাদন করতে করতে শিবনেত্র হয়ে স্বর্গের উৎপত্তিটা ঠাউর করার চেষ্টা করছিলুম। মুমতাজ বেগম। আহাহাহা, না না আমি লেসবিয়ান নই রে বাবা! কিন্তু ভদ্দরমহিলা শুধু তাজমহলেই খোদাই হয়ে নেই, আমাদের পাকস্থলীর গাত্রেও আমরণ জ্বল জ্বল করিয়া যাইবে। না না, যুদ্ধে হয়ত অনেক রাজা-রাজরা-বাদশাই তাঁদের পত্নীকে নিয়ে যেতেন, কিন্তু ক'জন তাদের ইস্পেশাল জেনানা তাঁবু ছেড়ে সেনা-ব্যারাকে আসত শুনি? আর যদি আসতও, ক'জনই বা অপুষ্টিতে ভোগা সৈন্যদের রক্ষে করার জন্য, সজল চক্ষে পুষ্টিবর্ধক রেসিপির দাওয়াই দিয়েছিলেন? তবু কুচুটেগুলো বলবে, "ইইইঃ, উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে চোদ্দ সন্তানের মা হলে সবাই অমন জ্ঞান ঝোলায় পুরে বিলোতে পারে", আমি বলব, কক্ষণো না, ইয়ে সির্ফ দিল-কা-দাওয়াতে হ্যায়। 

   লোককথা? আরে বাবা, লোকের কথা তো সবই। এই যে গোলাপসুন্দরী মুমতাজ বেগমের অবদান নস্যাৎ করছে যে তথ্যগুলো, ওগুলো কি দেবকথা? যেমন - খিচুড়ির মোগলাই সংস্করণই হল বিরিয়ানি কিংবা, আর একটু বিরিয়ানির গভীরে ঢুকলে, মাংস, বড়ো পিসের আলু ছাড়াও 'বিরিয়ান' শব্দটা উঁকি দেয়, যা কিনা ফারসি, যার থেকেই কিনা 'বিরিয়ানি' নামকরণ। অতএব মধ্যপ্রাচ্যের ও একটা জন্মদাতার হক চলে আসছে। ওরা বলছে, আরব মুলুকের যাযাবর জাতি নাকি মাটিতে গর্ত করে, বহু বছর আগে হাঁড়িতে চাল, মাংস, মশলা-টশলা দিয়ে রান্না করত। ওটাই বিরিয়ানির প্রপিতামহ। তারপর তৈমুরের কাঁধে বেতাল‌ সওয়ার হয়ে ভারতে প্রবেশ। 

   তৈমুর প্রায় জিতে যাচ্ছিলো, তীরে এসে তরি ডোবালো 'উনসুরু', দ্বিতীয় খ্রীস্টাব্দের তামিল সাহিত্যে বর্ণিত পদ। এটিও ওই হতভাগা সৈন্যদের জন্য তৈরি চাল, ঘি, মাংস, হলুদ, ধনে, গোলমরিচ, তেজপাতা সহযোগে রেসিপি। অতএব ভারত ঠাকুদ্দা তারের চশমা এঁটে তৈমুরের কাঁধে দুটো টোকা দিয়ে বললেন, "ওহে ছোকরা, আমায় বিরিয়ানি চেনাতে এস নে"।

   তক্ক চলবে, তক্ক চলুক, তবে উক্ত দেবভোগ্য জিনিসটির প্রচারে আসাফজাহি বংশের হাতই আসুক বা নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-র নাম, সিকন্দর কিন্তু হচ্ছে সেই মোগলরাই।

  তাই ধোঁয়া ওঠা অমৃতটির কিয়দংশ চামচ কিংবা দু-আঙ্গুলে যত্ন এবং তৎসহ ভালোবাসা মিশিয়ে মুখ গহ্বরে স্থানান্তরিত করার পুণ্য লগ্নে ভেবে নেবেন একবার - কউন জিতা অউর কউন সিকন্দর!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours