দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

লকডাউনে মানুষের জীবন গৃহবন্দি! একঘেয়েমিতে অতিষ্ঠ! তখন একমাত্র ভরসা আনলকড ফেসবুকে হবে-- এ আর কী এমন কথা! 

তবে অনেকেই ভাবেন লকডাউনে এই একমাত্র "আনলক"  মাধ্যমটি নিছক টাইম পাসের জায়গা বৈ তো নয়! হুট করে একটা রান্নার ছবি বা গানের ভিডিও স্যুটকে আপনার ওয়ালে ট্যাগিয়ে দেওয়ায় ঘাড়ের উপর মামদো বাজিতে ভুক্তভোগী হতে পারেন! তবে, ব্যাতিক্রম তো আছেই! সেই ব্যাতিক্রমী অবশ্যই গান্ধর্বী! তাই নেটিজেনরা সমস্বরে বলছেন, চরৈবতি গান্ধর্বী! কিন্তু কেন?

সুস্থ সংস্কৃতি জীবনের ধারক ও বাহক। সেই কাজটি করে যাচ্ছে রামপুরহাটের গান্ধর্বী সোসাইটি। "সোসাইটি" দেখে ভাববেন না কোন লাভজনক সংস্থা! তবে মানসিক খোরাক অর্থাৎ সঙ্গীত, নাট্যচর্চার পাশাপাশি, সমাজের দুঃস্থ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পিছপা হয় নি কখনও! এখানেই গান্ধর্বীর বিশেষত্ব। মূলতঃ সঙ্গীত চর্চা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকে গান্ধর্বী। গ্রামবাংলার ছোট ছোট শিল্পীদের হাতে গড়ে প্রকাশের পাদপ্রদীপে তুলে এনেছে এই অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে রাজ্য ও স্বদেশ ভূমি ছাড়িয়ে বিদেশেও গান্ধর্বী আজ একটি নাম! সুন্দরবনে আমফান পীড়িত মানুষের কাছে ঔষধ ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে গান্ধর্বী। শুধু তাই নয় লকডাউনের কবলে মানুষ যখন অসহায়, সেখানেও নিরবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিল গান্ধর্বী। শুধু তাই নয়, যে মাইক ও সাউন্ড সারা বছর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দিয়ে বহু কর্মীদের গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করে, তাদের কথা  ভোলে নি গান্ধর্বী! নিজেরা পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য তো করেছেই করোনা আবহ ও লক ডাউনের সময়, পাশাপাশি সবার কাছে আবেদন করেছে এই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তাতে কতটা তাঁরা সফল হতে পেরেছেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা তাঁরা এই অসহায় মানুষের কথা ভাবতে পেরেছেন ও নিজেরা এগিয়ে এসেছেন। তবে, এব্যাপারে কৃষি মন্ত্রী শ্রী আশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহাশীর্বাদ ও সহযোগিতা গান্ধর্বী সব সময় পেয়েছেন, বলে জানিয়েছেন চৈতি।

 এই সাহায্য প্রাপ্তদের স্বীকারোক্তি খুবই আশাব্যাঞ্জক। একজন বলেন, ঝড় একদিন থেমে যাবে। কিন্তু মনে থেকে যাবে এই স্মৃতিটুকু-- কেউ তো পাশে দাঁড়িয়েছিল! 

জানা গেছে, এই করোনা আবহে তাঁরা সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে কোন সমাবেশ করে নি। তবে ফেসবুকের লাইভ পেজে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছে। তাঁদের দুটো ফেসবুক পেজ থেকে এগুলো সম্প্রচারিত হয়। এক, গান্ধর্বী সোসাইটি। দুই, চৈতি মজুমদার গানের তরী। এই দুটো পেজ থেকে মাসে দুটি করে খুব উন্নত মানের অনুষ্ঠান হয়েছে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন গান্ধর্বী, বাংলাদেশ ও কোলকাতার বিভিন্ন শিল্পীরা। সঙ্গীত ছাড়াও গান্ধর্বী পেজে বীরভূমের আনন নাট্য সংস্থার সাহচর্যে নাটকের অংশ বিশেষ অভিনীত হয়েছে। জেলার বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব বাবুন চক্রবর্তীর ছাড়া এটা সম্ভব হতো না, বলে জানান গান্ধর্বীর কর্ণধার চৈতি মজুমদার। এছাড়াও গানের তরী পেজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষা ও প্রেমের গানের অনুষঙ্গ ছিল কালজয়ী। উপস্থিত ছিলেন কোলকাতার বনজিত দাশগুপ্ত, মঞ্জরী নাগ। চৈতি মজুমদার ছাড়াও ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আব্দুল ওয়াদুদ। সঞ্চালনায় ছিলেন বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষিকা সংহিতা চক্রবর্তী।  মঞ্জরী, চৈতি ও সংহিতা-- তিন জনেই শান্তি নিকেতনের প্রাক্তনী। 

রাগে অনুরাগে বিখ্যাত এসরাজ ও সারেঙ্গী বাদক দেবাশীষ হালদারের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নৈসর্গিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে দর্শকদের মনে। 

শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত নৃত্য সংস্থা কনীনিকা নৃত্য মন্দির আয়োজিত অনলাইন রবীন্দ্রনৃত্য প্রতিযোগিতায় বড়দের বিভাগে প্রথম হয় গান্ধর্বী সোসাইটির ছাত্রী অনিন্দিতা দে। ছোটদের গ্রুপে দ্বিতীয় ও সপ্তম হয় সুদত্তা মন্ডল ও আলপ্তি দাস।  গান্ধর্বী নৃত্য শিক্ষিকা শ্রীমতি কাবেরী সিং এদের নিজ হাতে গড়ে পিটে তৈরি করে নেন। এগুলোই আসল প্রাপ্তি ও তৃপ্তি গান্ধর্বীর, বলে জানান চৈতি। 

তিনি জানান, গান্ধর্বীর গানের ছাত্রছাত্রীরা সুনামের সঙ্গে নয়া বঙ্গ সংস্কৃতি, উত্তর বঙ্গ সংস্কৃতি, শিলচর সংস্কৃতি মঞ্চ, শিলচর ইয়ুথ কয়্যার মঞ্চ, এছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন পেজ থেকে, এমনকি সুদূর বাংলাদেশের অনুষ্ঠানেও তারা লাইভে অংশ নিয়েছেন। গান ছবির কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রিয়াঙ্কা মুখার্জী, মনীষা মুখার্জি, সুচেতা গুপ্ত, পাঞ্চালি চ্যাটার্জী, সৌরদীপ চ্যাটার্জী, তৃষিতা মজুমদার,  মঞ্জিস মজুমদার, রজত মুখোপাধ্যায়, তনয়া মন্ডল প্রমুখরা দর্শকদের কাছে মুগ্ধতার কোন অবকাশ রাখে নি। এছাড়াও ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গান্ধর্বী আমন্ত্রিত ছিল মুম্বাইয়ের ভয়েস অফ ফাউন্ডেশন সংস্থা। গান্ধর্বীর কর্ণধার চৈতি মজুমদার আরও বলেন,  অর্থের পিছনে ছোটা নয়, মানুষকে নির্মল আনন্দের ঠিকানা দেওয়া আমাদের কাজ! তাই নিজের স্বল্প সামর্থ্যের গণ্ডির মধ্যে এগিয়ে চলেছে গান্ধর্বী! 

"চরৈবতি গান্ধর্বী" আজ তাই জীবনের ট্যাগ লাইন!



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours