সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
ওই পারেতে রান্না করি,
এই পারেতে শুই,
কখনও আমি স্বদেশবাসী,
কখনও বিদেশ ভূঁই॥
গরম ভাতের থেকে গন্ধ ওঠে,
এপারেতে খাই জল,
চাষের জমি লাঙ্গল দিয়ে,
ফলায় সোনার ফসল।
মুক্ত আকাশ পানে দাঁড়িয়ে,
প্রাণ বায়ুর শ্বাসপ্রশ্বাস,
দুই দেশেতেই কর্ম আমার,
সীমানায় আমার বাস॥
এই লেখনীর মধ্য দিয়ে বোঝাতে চাইছি আজকের এই বিষয়টি। হ্যাঁ ঠিক তাই। এমন এক পরিবারের কথা বলবো যার রান্নাঘর বাংলাদেশে আর শোবার ঘর ভারতে। অদ্ভুত হলেও এটাই বাস্তব।
খুব বেশি দূরে নয়। কলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাগদা ব্লকের অখ্যাত গ্রাম বয়রা।
স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও রেজাউল মণ্ডল দুই দেশের সীমানার বাসিন্দা। বছর ৬৫ বছরের রেজউল মন্ডলের সীমান্তের এপার-ওপার নিয়ে ঘর আর তার দুটো ঠিকানা। ভারতের কাছে বাগদা ব্লকের বয়রা গ্রামের লোক। আবার বাংলাদেশের কাছে পরিচিত যশোর জেলার গদাধরপুরের বাসিন্দা। কিন্তু দু’পারের সীমান্তরক্ষীদের কাছে রেজাউলের পরিচিতি ৩৯/১১ পিলারের বাসিন্দা হিসেবে।
দেশ ভাগের সময়ে বাড়ির উঠোনের মাঝ-বরাবর চলে গিয়েছে দেশভাগের রেখা। দেশ ভাগের অদৃশ্য রেখা তার বশতভিটে ভাগ হয়ে একটা অংশ ভারতে। বাকি অর্ধেক চলে যায় বাংলাদেশের মধ্যে। কাঁটাতারের বেড়া বসেনি হয়তো কিন্তু দিনরাত চলে বিএসএফ আর বিজিবি-র নজরদারি।
একদা সময়ের সম্ভ্রান্ত মণ্ডল পরিবারকে দেশ ভাগের সময় ওদেশে থাকা বিষয় সম্পত্তি খোয়াতে হয়ছে। এখন সম্বল বলতে সীমান্ত মধ্যবর্তী ষোলো বিঘা চাষ জমি। যার নয় বিঘা ভারতে আর সাত বিঘা বাংলাদেশে। চাষের পর আগে দু’দেশের অনুমতি নিতে হবে তবেই সাড়ে দশ মন ধান এদেশে আনতে পরবেন। কিন্তু কালের নিয়মেই বাংলাদেশের ফসল বাংলাদেশের বাজারেই বেচে দিতে হয়। আজও সেই কাগজ যত্ন করে রাখা রেজাউলের সংগ্রহে।
বয়রা গ্রামে প্রায় ৬০ ঘর বাসিন্দা। সব বাড়িই সীমান্তের পিলার ঘেঁষা। কিন্তু অর্ধেক ভারতে, অর্ধেক বাংলাদেশে এমন বাসিন্দা কেবল মণ্ডল পরিবারই। সংসারও ছড়িয়ে পড়ছে দুই দেশেই। রেজউল মণ্ডল মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন যশোরে। এক ছেলে হাফিজুর কাজ করেন কলকাতা পুলিশে। রেজাউল মন্ডল কিন্তু নিয়মিত ট্যাক্স দিয়ে থাকেন দুই দেশের সরকার কে। বাংলাদেশের ৯নং স্বরূপদাহ ইউনিয়ন পরিষদে নিয়মিত ট্যাক্স জমা করেন, আর ভারতের জন্য ট্যাক্স জমা করেন। তিনি নাগরিক হিসাবে কিন্তু ভারতীয়। কিন্তু সীমানা ভাগ করে দিয়েছে তার হেঁসেল আর শয়ন কক্ষ। আর এই মজার বিষয়টা তিনি খুব উপভোগ করেন আর ব্যতিক্রমী হিসাবে যে ইতিহাসের পাতায় তিনি থাকবেন এটা তাকে আরও রোমাঞ্চিত করে।
লেখার সময় আমিও কিছুটা আনন্দ খুঁজে পেলাম এই ভেবেই রেজাউল মন্ডল এক পা ভারতে এক পা বাংলদেশে রেখে মুক্ত আকাশের নীচে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারেন। আসলে পাখির নেই সীমানা, বায়ুর নেই কোন ঠিকনা। তাতে হয়তো দেশ ভাগের যন্ত্রণা বা গ্লানি কিছুটা লাঘব হয় নিশ্চিত।
(উক্ত কবিতাটি প্রতিবেদকের রচিত)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours