সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:
প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জির প্রয়াণে অনেক স্মৃতি মণিকোঠায় ভীড় করে আসছে। কিছু মূল্যবান সময় তাঁর সঙ্গে কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার রাজনৈতিক জীবনে প্রেরণাস্বরূপ।সেটা ২০০১সাল, বিধানসভা নির্বাচন, অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্রের guidance-এ কংগ্রেস দলের ইস্তাহার লিখছি। প্রকাশের আগে প্রনববাবুর ঢাকুরিয়ার বাড়িতে গিয়েছি প্রায় ৩০ পৃষ্ঠার ইস্তাহারটা দেখিয়ে ভুলভ্রান্তিগুলি শুধরে নিতে। ইস্তাহারটা হাতে নিয়ে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিটি পৃষ্ঠা দেখে নিয়ে একটা সংশোধন করে নিতে বললেন এবং বুঝিয়ে দিলেন ভুলটা। নিজেই dictation করে সুন্দর শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাক্যটা সম্পূর্ন করতে সাহায্য করলেন। অবাক হয়ে গেলাম ওনার পর্যবেক্ষন শক্তি দেখে। ঐ ভুলটা আমাদের চোখে পড়েনি, কিন্তু কি অবলীলায় এত অল্প সময়ে শুধু পাতা উল্টেপাল্টে প্রায় ৩০ পৃষ্ঠার ইস্তাহারের মূল্যায়ন করলেন। ওনার বোঝানোর ব্যাপারটা ছিল সত্যিকারের শিক্ষক মহাশয়ের মত।
আর একবার "কংগ্রেস বার্তা" বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হবে। আমার উপর ভার পড়ল প্রনববাবুর ক্যাসেটবন্দি আত্মকথা আমাকে অনুলিখন করে দিতে হবে ।সংসদ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণ করেছিলেন, সেটাই আমি লেখার মাধ্যমে প্রবন্ধের রূপ দিয়েছিলাম।কি অসাধারন স্মৃতির উপর দখল । ১৯৬৯ থেকে তাঁর সংসদের ভাষণ এমনভাবে স্মৃতিতে তুলে আনছিলেন মনে হচ্ছিল সেই সময়টা চোখের সামনে উপস্থিত ।যেটা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছিল তিনি বলেছিলেন, "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন মুজিব সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমি সংসদে দীর্ঘ সময়ের বক্তৃতা দিয়েছিলাম।তার পর দিন সকালে ভারতের প্রতিটি সংবাদপত্রের হেডলাইন- ভারতই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা প্রথম বাংলাদেশ কে স্বাধীন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।" আরও একটা ছোট্ট ঘটনা সামান্য হলেও আমার কাছে খুব শিক্ষনীয় এখনও। ১৯৮৬/৮৭ সাল হবে, আমি তখন ছাত্র পরিষদের নেতা হিসেবে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার পরিচিত মুখ। বালুরঘাট কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। প্রনব মুখার্জি সবে কংগ্রেস ছেড়ে নিজস্ব দল গড়েছেন।তার আগে বিশ্বের সেরা Finance Minister হিসাবে তাঁকে আন্তর্জাতিকস্তরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। তিনি তাঁর নতুন দলের প্রচার করতে বালুরঘাটের কাছে পতিরামে এলেন।
আমি দেখা করলাম এই অনুরোধ নিয়ে প্রনবাবুকে বললাম যে, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫ তম জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে, তাই আপনি যদি আমাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষমূর্তি স্থাপনের জন্য কিছু সাহায্য করেন তাহলে কলেজ প্রাজ্ঞনে সংসদের তরফে ঐ মূর্তি বসাতে পারব।" প্রনববাবু সব কথা শান্তভাবে শুনলেন। মুখে পাইপ, আলতো করে মাথার চুলে আঙুল বোলালেন এবং বললেন, "দ্যাখো, আগেতো আমার সবইতো ছিলো। এখন তো কিছুই নেই।" এই বলে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অপারগতা জানালেন । সেদিন আমার উদ্দ্যেশ্য হয়ত সিদ্ধ হয়নি কিন্তু প্রনব মুখার্জির মহত্ত্ব এখানেই তিনি আমাকে কোন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেননি। যেটা পারবেন না সেখানে তাঁর অক্ষমতা জানিয়ে দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতা হিসাবে অন্যদের সঙ্গে এখানেই তাঁর মৌলিক তফাৎ। এখনকার রাজনীতিতে এমন চরিত্র সত্যিই দুর্লভ।
তাই মনে হয়,স্মৃতি সততই সুখের।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours