দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

"হাতক দরপণ মাথক ফুল,

নয়নক অঞ্জন, মুখক তাম্বুল,

হৃদয়ক মৃগমদ, পীমক হার,

দেহক সরবস্ব, গেহক সার,

পাথীক পাণ, মীনক পানী,

জীবক জীবন হাম তুরা জানি।" 

                                   - বিদ্যাপতি 

জীবন-মরণ সীমান্তে আমরা সবাই অনন্তের পথে ভ্রাম্যমাণ পথিক। ঝোলা কাঁধে মুসাফিরানার আত্মজ। কিন্তু প্রেমের পথে? প্রেম? সে তো দৈব। সত্যিই কি তাই? মানবতায় তবে প্রেম নেই? বৃন্দাবনের পথে পথে ওঁরা তবে দেবত্বের অধিকারী ছিলেন? তাই তো। তবে সেই চিরন্তন কাল‌ হতে পার্থিব সব মুকুলিত প্রেমপুষ্পে ওঁদের মধুগুঞ্জনের ধ্বনি কেন আজও শোনা যায়? 

শুভা মুদগলের এই গান আগেও শুনেছি। যদিও ভিতরকার শব্দবন্ধনী আমার ভিতরে পৌঁছায়নি এমন পথে। 'Raincoat' যদিও আগে দেখিনি। কিন্তু 'মথুরা নগরপতি' কাল রাত্রিকে গ্রাস করলো ঠিক কি কারণে? 

গোটা গানকে যদি একটি শব্দে বাঁধার চেষ্টা করা যায়, তাহলে আমি তুলে নেব 'অভিমান' শব্দটি। চারটি শব্দ মোটে। ব্যাপ্তি চারশত জন্ম অতিক্রান্ত। প্রেম একে অতিক্রম করতে পারেনি। পারবেও না। এ এক অনতিক্রান্ত বিহঙ্গসম বিস্তার। 

সকাল হচ্ছে। এ সকালের ভৈরবীর বিস্তার অন্যরকম। এ সকালের আলাপে অন্য ভোরের আভা লেগে।

'Manohar vesh chhod Nandraj

Sar se utar ke sundar taj

Raj dand chhod bhumi par waj

Phir kahe bansuri bajao'

কি প্রয়োজন ছিল তোমার? দুরাচারী কংস বধ করে মথুরা নগরপতি হয়েছ। যাদবদের একত্রিত করে স্ব-শাসিত নগর স্থাপনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছ। হে দ্বারকাধীশ, আর্যাবর্ত জুড়ে তোমার রাজদণ্ডপাটের জয়গান। কুরু রাষ্ট্রে তোমার এবং ভ্রাতা হলধারী বলরামের সসন্মান আত্মীয়তা। এমত উচ্চকোটির সহাবস্থান থেকে সুদূর‌ জন্মান্তরসম জীবনে কেন? রাজদণ্ড মাটিতে ফেলে, বাঁশি তুলে নেওয়া কি মানাচ্ছে তোমায়? 

তোমার মনে কোনও জন্মান্তরের‌ বিরহগীত জন্মাচ্ছে না তো? 

এই যে, সুকোমল শয্যা তোমাকে নিশ্চিন্ত নিদ্রা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, কারণ কি তার? রাজকার্যে রাজা কৃষ্ণের মন লাগছে না। কেন? অর্ধরাত্রে‌ সারথিকে ডেকে কোথায় যাওয়ার এত আকুলতা তোমার? 

হয়ত কালই তোমাকে কুরু-পাণ্ডবকুলের অধর্ম-ধর্মের মীমাংসায় মধ্যমণি হতে হবে। অন্তঃপুরে যাজ্ঞসেনী কৃষ্ণা অপেক্ষায়মান তার সখার কাছে প্রাণের কথা বলার জন্য। রাণী রুক্মিণী, যোদ্ধা সত্যভামা প্রতিদিনের মতোই তোমার নিভৃতচারণের জন্য সুসজ্জিতা হবেন। এই খ্যাতি-যশের সুগন্ধমাখা রাজৈশ্বর্য ফেলে হে প্রবল প্রতাপশালী, আর্যাবর্তের অন্যতম কূটনৈতিক, রাজনীতিবিদ পার্থসারথি! ধীর পদক্ষেপে যমুনাতীরে কেন তুমি? 

'Use kahe bhul na pao???'

এখনও পারোনি ভুলতে? এখনও তার জন্য বিরহকাতর হচ্ছ? কেন? কিন্তু সে তো এখন‌ পুরোদস্তুর সংসারী। তোমার ও‌ মনে থাকার কথা নয়! আজ তার তো প্রতি অঙ্গের তরে প্রতি অঙ্গ আর অশ্রুমোচন করে না। তবে তুমি আজ কেন দরদী হচ্ছ???

চেয়ে দেখো, দ্বারকাধীশ, আজ তোমার এই সহস্রাব্দের শোকাকুলতা কি কেউ বুঝছে? যুমনার যূথিকাবদ্ধ বৃক্ষরাজি থেকে অচঞ্চল স্মৃতিছায়ামাখা ঢেউ, পুরনারীগণ থেকে চঞ্চল‌ শুক-সারি, প্রত্যেকে, প্রত্যেকের স্বরে অভিমানের কপাট হাট-হাট। কারণ তারা সেই চিরন্তন অপেক্ষার সাক্ষী, যে অপেক্ষার তলায় রক্তের‌ যতিচিহ্ন। তারা সেই মূক প্রতীক্ষার দোসর। যার অক্ষরমালা স্বরভাঙা অশ্রুতে সিক্ত। তারা জানে, এ প্রেমের পথ চিরন্তন। এ পথের ধূলিকণারাও জানে, তাকে আসতে হবেই। যুগান্তের পথ অতিক্রম করে, সহস্রাব্দের সূর্য মাথায় নিয়ে তাকে তার চৌকাঠে দাঁড়াতে হবেই। এ অধিকার অর্জিত। এ জোর আত্মার।

তবু তারাও যে সেই পল্লীবধূর অভিমানী স্বরের দহনে দাহিত হয়েছে। তারা তো প্রশ্ন করবেই -

'Mathura Nagarpati kahen tum Gokul jao???'

এ প্রশ্ন আবহমানের। এ প্রশ্ন ও চিরন্তনী হয়ে বিরহের গায়ে লেপ্টে থাকে। এ প্রশ্ন আছে বলেই তো উত্তর সন্ধানে বারংবার প্রেমের পূজায় নবজাতক হওয়া। বারংবার বিচ্ছেদের যাওয়ায় মিলনের ফিরে আসার টান। যে টান ভূলোক-দ্যুলোককে অনিবর্চনীয় বাঁধনে বেঁধে রেখেছে।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours