পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

বাম শাসনের স্বর্ণযুগ বলা যায়  নব্বই দশকের শেষ দিক। সেই সময় আমার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। অত্যাচার এবং অতিশাসনে গোটা বাংলা তখন অলক্তক। গ্রামে গঞ্জে কাজ করবার সুবাদে খুব কাছ দেখেছি সেই লাল শাসনের দশ দিক। কেউ তখন ভাবেন নি এই শাসনেরও শেষ আছে। বলতে দ্বিধা নেই, এগারো সালে প্রায় তিন যুগের বাম শাসন শেষ হওয়ার পিছনে তৃণমূলের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বা ভালবাসা যতটা ছিল তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ছিল বাম তথা সিপিএমের প্রতি সাধারণের বিরক্তি, ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণা। তৃণমূল ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত ভাল, তারা বামেদের কাছ থেকে যা যা দেখেছিল বা শিখেছিল তার সঙ্গে নিজেদের শিক্ষা মিশিয়ে এক অনবদ্য প্রয়োগ করল তাদের আমলে। ভুলে গেল বামেদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিতৃষ্ণাকে। ফল? অল্পদিনেই অতিশাসনে বামেদের ছাড়িয়ে গেল তারা। মোহ কাটতে লাগল মানুষের। এর সুফলটা নেওয়ার মত দল এই মুহুর্তে বাংলায় আছে একটিই, বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনে তারা সেটা বুঝেও গেছে। কারন গত লোকসভাতে যে যে আসনে যারা বিজেপির হয়ে জিতেছেন তারা অনেকেই নিজেরাও ভাবেননি জিতে যাবেন। তাদের অনেককে সাধারণ মানুষ চোখে দেখা তো দূরে থাক, নামই শোনেনি। তা স্বত্বেও তারা জিতেছেন, জঙ্গল মহলের মত জায়গাতেও ভোট বাড়িয়েছে বিজেপি। তাতেই বিজেপির মনে হয়েছে মানুষ তাদের বড় ভালবাসেন, যাই হোক না কেন এবার তারা আসছেন।

বলা যায় না, এগারোর পুনরাবৃত্তি হতেও পারে বা পারতো। রাজনীতিতে কিছুই অসম্ভব নয়, কিন্তু বাংলা দখলের জন্য মোদী বা শাহের যে ব্যকুলতা লক্ষ্য করা যায় তার বিন্দুমাত্র দেখা যায় না বিজেপির বাংলার নেতা বা নেত্রীদের মধ্যে। যে দল বাংলাতে তাদের শাসন কায়েম করতে চায় সেই দলের বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা এবং অজ্ঞানতা। ভুলভাল কথায় তৃণমূল নেতৃত্ব এর আগেই পিএইচডি করেছেন। কিন্তু ভুলভাল কথায় তৃণমূলকে পিছনে ফেলতে আদাজল খেয়ে লেগেছে বাংলার বিজেপিও।

কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা দেশের ধ্রুপদী ভাষার তালিকায় স্থান পায়নি বাংলা। ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের সব চেয়ে মিষ্টি বা শ্রুতিমধুর ভাষা (দ্বিতীয় ও তৃতীয় যথাক্রমে স্প্যানিশ ও ডাচ) হিসেবে স্বীকৃত ভাষা বাংলাকে আমাদের দেশ ধ্রুপদী বলে মানতে নারাজ। বাংলা ভাষার কৌলীন্য এবং ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে কয়েকদিন আগেই গোটা বাংলা ও বাঙালির ভাবাবেগকে চরম ধাক্কা দিয়েছেন বিজেপির জনৈক মুখপাত্র তরুণজ্যোতি তিওয়ারি। এই তিওয়ারিই আবার কয়েকদিন আগে আসানসোল পুরসভার সাইনবোর্ডে বাংলা না থাকার একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন সামাজিক মাধ্যমে। সেটা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। যাই হোক বাংলায় শাসন করব অথচ সেখানকার ভাষার ইতিহাস, কৃষ্টি, গৌরব নিয়ে জানব না, উল্টে আলটপকা মন্তব্য করব, এটা বোধ হয় বাংলার মানুষ ভাল ভাবে নেবেন না। অন্তত বাঙালি হিসেবে আমি তো এটা মেনে নিতে পারছি না।

মাননীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আপনাদের লক্ষ্য এবং মোক্ষ্য রাজনীতি। ক্ষমতা দখলের জন্যই নানাবিধ কাণ্ডের অবতারণা। তা রাজনীতির স্বার্থেই কি একটু মানুষের আবেগ, অহংকার, গর্ব নিয়ে সামান্য চর্চা করা যায় না। যে ভাষার কারনে গোটা বিশ্বে আজ ভাষা দিবস পালিত হয় সেই ভাষার কোনও ইতিহাস নেই? তথাকথিত হিন্দির পরে যে ভাষায় সব চেয়ে বেশি মানুষ ভারতে কথা বলেন সেই ভাষার কোনও নিজস্বতা নেই? যে ভাষার কবি নোবেল পুরস্কার পেয়ে দেশকে সাহিত্যে সংস্কৃতিতে অন্য মাত্রা এনে দেন সেই ভাষা অপাংক্তেয়? মেনে নিতে পারলাম না।

কেন্দ্রীয় সরকার আমার ভাষাকে ধ্রুপদী বলুক না বলুক সে ভাষা আমার কাছে মাতৃসম। তার সম্মান, তার গৌরব কোনও রাজনৈতিক দল, থুড়ি নির্বাচিত সরকারের দয়ার স্বীকৃতির তোয়াক্কা করে না। শুধু এটুকুই অনুরোধ, রাজনীতি আপনাদের পেশা, ব্যবসা। সেখানে ভাষা শুধুই মানুষকে বোকা বানাবার অঙ্গ বা অস্ত্র। কিন্তু আমাদের কাছে ভাষা আমাদের পরিধেয়, আমাদের লজ্জাবস্ত্র। তার সুরক্ষা বা সম্মান রক্ষার দায়ও আমাদের হাতেই। এরপর কোনও রাজ্য দখল করতে চাইলে সেখানকার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা এগুলি নিয়ে আগে থেকেই একটু চর্চা করে নেবেন। বাংলার বিজেপি নেতাদের কাছেও অনুরোধ, ভাড়া করে নেতা নিয়ে এসে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে কি অপমান না করলেই নয়? এ তো বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে আপনাদের দিকেই। নাকি অতি আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছেন আপনারাও, যেমন ২০১১ –র আগে পর্যন্ত নিশ্চিন্ত ছিলেন বামেরাও। মানুষের বিরক্তিতেই গদি গিয়েছিল তাদের, মানুষের বিরক্তিতেই হয় তো গদি পাওয়াই হবে না আপনাদের।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours