দেবস্মিতা ধর, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

জীবনপথের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে জিজ্ঞাসা চিহ্ন, বিস্ময়ের অপরানুভূতি কখনও রূদ্রবেশে কখনও আবার সজল‌ স্নেহাশ্রুর কালিতে লিখিত থাকে, যা আমাদের ভাবায়, হাসায়, কাঁদায়, আবার কখনও কখনও মনের একান্ত গভীরে দৃঢ় ছাপ ফেলে যায়। 

ভূত আমি সেভাবে-এভাবে-কোনওভাবেই দেখিনি। অত সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য আমার হয়নি। মৃত্যুর পর মানুষ ড্যাঙডেঙিয়ে পৃথিবীর লোকজনদের কাউকে কাঁদিয়ে, কাউকে হাসিয়ে, কাউকে আবার ফাঁসিয়ে কই যায় তা নিয়ে এত কাগজ নষ্ট হয়েছে, যে কহতব্য নয়। তবু এই একটা প্রশ্নে পাড়ার লক্কা খাঁদু থেকে চোয়াড়ে দাদু, হক্কলের কৌতুহল লেভেলের টি.আর.পি সবসময় হাই। 

আপনাদের যেমন বাড়ি ঘেরাও করে পাঁচিল আছে, আমাদেরও আছে। আপনাদের পাঁচিলেও যেমন ন্যাজওয়ালা বেড়াল আছে, আমাদের ও আছে। সকলেরই থাকে। যাদের পাঁচিলে থাকে না তাদের ঘরে থাকে, যাদের ঘরে থাকে না তাদের বর-এ থাকে.... ইত্যাদি ইত্যাদি। তা যাকগে। 

তো গপ্প হচ্ছে, আমাদের পাঁচিলের সাদা-ছাইরঙা ঘন্টি বেড়ালের বছরে যে ঠিক ক'বার ছানা হয় তার হিসেব এখন আর রাখা হয়না‌। হওয়ার আগে নাদু ভুঁড়ি দেখে টের পাই, হওয়ার পর কুঁই কুঁই শব্দে (অবশ্যই ছানাগুলোর, ঘন্টি বাচ্চা দিয়ে কুঁই কুঁই করবে কেন?) কিছু বাঁচে, কিছু কিডন্যাপড হয়, কিছু হুলোর ভোগে যায়। তো এই ঘন্টিরই কোনও এক সুসময়ের সন্তান, আমাদের ঘরের স্নেহ-ভালোবাসা-দয়া-মায়া আরও যা যা আছে, সব পাইকারি রেটে হাসিল করে নিয়েছে। ভদ্রলোক বর্তমানে ফুটবল, বুট্টুম, ফুটু নামে খ্যাত, তাঁর ছবি আপনারা এই অধমের দৌলতে দেখে ধন্য হয়েছেন। 

আজকের গপ্প কিন্তু ফুটবলকে নিয়ে নয়। ঘন্টির শেষ রাউন্ডে তিনটি ছানা হয়েছিল, এই কয়েকমাস আগে। তার একটির‌ নাম মা রেখেছিল, তার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে, ভুতু। বাকি দুটোর স্বভাব, জন্মদাগ মিলিয়ে আমি নামকরণ করেছিলুম – গুণ্ডু, আর‌ দাগু। অবশ্যই পোষা নয়, তবে তাদের ঘরে আনাগোনা আছে। এবং এই করোনা-লকডাউনে চটকে-চৌষট্টি জীবনে এরাই আমার এন্টারটেইনমেন্ট হয়েছে। তো তিনছানার মধ্যে ভুতুকে নিয়েই আজকের গপ্প‌। 

ভুতুর দিকে তাকালে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে ওর গোঁফ। এইটুকু বয়সেই এমন এঁচোড়াপক্ক গোঁফ আমি অন্ততঃ আগে দেখিনি। গাত্রবর্ণ কালো, লোমশ, শুধু বুকের কাছ আর চারটি পায়ে সাদা ছোপ, যেন মোজা পড়া। একটি পায়ে আবার সাদা ছোপ একটু ওপর অবধি উঠৈ গেছে। চোখ জ্বলজ্বলে গুলুগুলু। ভোকাল খুব জোর নয়, তবে পিয়ানো‌-টিয়ানো‌ শোনার আশা করবেন না। এত কালচারাল বেড়াল পাঁচিলে ঘুরবে না, কনসার্ট করবে। প্রথম দিকে ব্যাটা ভিতুই ছিল, গুণ্ডুর মতো জন্মবিপ্লবী নয়। ঘরে ঢুকতে ভয় পেত এবং ঢুকলেও বেরিয়ে যেত। ক্রমে ফলোয়িং বড়দি (গুণ্ডু) করে বুঝে গেল, এই ঘরে যে আলখাল্লা পড়া, মাথায় বড়ো লোমের (পড়ুন চুল, বেড়ালদের কাছে তো ওটা লোমই) প্রাণীটা থাকে তার থেকে আর যাই হোক, কোনও ভয় নেই, বরং মজা আছে। তারপর থেকে যখন-তখন ঢুকে পায়ে পড়া, গায়ে ন্যাজ লাগিয়ে ঘুরঘুর এসব হকের ব্যাপার হয়ে গেলো। এমনকি দিদার চোখরাঙানিকে থোড়াই কেয়ার করে বড়ঘরেও চরতে শুরু করল। দিদাও ক'দিন পর থেকে দেখি -"আহা গো, আমার ভুতু কই" শুরু করেছে। আমি তো শুরুতেই বুঝেছিলুম, এই বীরাপ্পানগোঁফু লম্বা রেসের বেড়াল। বড়ো হোক না একবার, হুলোগুলোকে এমন বচ্চন-টাইট দেবে না! আহা! তখন আমি "আমারই পায়ে পায়ে হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চা, কত্ত নাম করেছে" বলে গর্বিতভাবে পুলকিত হব। 

দিন এমনভাবেই কাটছিল। কখন যে কে কিভাবে মন নামক ঘরটায় দখলদারি করে, ঘরটা নিজেও জানে না। টেরটি পাওয়া যায়, তার অনস্তিত্ব যখন জাহির করে, সে নেই আর। একদিন-দুদিন হল। ভুতুর পাত্তা নেই। এত বড়োও তো হয়নি। গেল কোথায়? তিনদিন, চারদিন। নেই সে। কোত্থাও নেই। মন নানানভাবে কু ডাকলেও, মনকে অন্য কথা বলছিলাম। হয়ত কেউ নিয়ে গেছে, বা হয়ত...আর ভাবতে ভালো লাগছিল না। 

সেদিন সকালবেলা। যথারীতি দেরি করে বিছানা তুলছি। হঠাৎ পাশের বাড়ির শিবুমামার মায়ের উচ্চকণ্ঠ কানে এল। কল্যাণমামাদের ডাকছে। দুটো বাড়িই আমাদের লাগোয়া। ছানাপোনাগুলো ওদের বাড়িতেই শুতো। ওদের চিলেকোঠাতেই পৃথিবীর মুখ দেখেছে। কাজেই ‌শিবু মামার মায়ের ডাকে কানখাড়া করলাম। "তোমাদের একখান বিড়াল হারায়েসিলো না? আমাগো পাঁসিলের ধারে একখান বিড়াল‌ ক'দিন হল মইরা পড়ে আসে‌। আমরা ভাবি গন্ধ কোত্থেকে আসে...." কল্যাণমামার গলা কানে এল - "তাই নাকি? আমরা ভাবি কোথায় গেল?" বিছানা ঝাড়ছিলাম। দৌড় লাগালাম। "মা, ভুতু মরে গেছে। শিবুমামাদের পাঁচিলের ধারে পড়ে আছে।" মা শশব্যস্ত হয়ে এল - "ওই দ্যাখ, নির্ঘাৎ ওই কুঁদো হুলোটা মেরেছে। একা পেয়েছে কোনওভাবে, ছেলেমানুষ।" প্রতিবাদী সুরে বললাম - "নানা, কোনও রোগও তো হতে পারে।" মা নিজ মতে অটল রইলো। আমি একা ঘরে স্তব্ধ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভুতুটা চলে গেল? খাওয়ার সময় ঠিক পাঁচিলে ওর ভাই-বোনেদের সঙ্গে ন্যাজ নাড়তে নাড়তে আসা, ঘরে ঘুরঘুর করা, মুখের দিকে তাকিয়ে 'মিঁউ' - ফ্রেমের মতো চোখের সামনে আনাগোনা করতে শুরু করলো। আচ্ছা, হুলোর কামড়েই হোক বা কোনও রোগে, বাঁচার চেষ্টা নিশ্চয়ই করেছিল।  জীবনের কাছে হেরে যাওয়ার সময় শেষ 'মিঁউ'-টা ঠিক কিভাবে করেছিল? ওরও চোখে ভাসছিলো, এই পাঁচিল, খেলা, ঘুরঘুর করা? উফফফ, বেশি ভাবাটা রোগ আমার। গলাটা ব্যাথা ব্যাথা করছিলো। গাল বেয়ে দু'ফোঁটা গরম, নোনতা জলের ফোঁটা জানান দিলো, ছোট্ট পশুটা কতটা মনের মধ্যে ছিল। ওর প্রাণহীন, ছটফটানিহীন, মিঁউহীন দেহটা দেখতে যেতে পারিনি আমি। প্রিয়জনদের এই নিথরতা আমার অসহ্য লাগে। ভারতীয় দর্শনের প্রতি অগাধ আস্থাশীল আমার মাতৃদেবী বললেন - "ওর হয়ত এইটুকুই আয়ু ছিল। এর পরে যেন ভালো জন্ম হয়"। 

সেদিন বিকেলে বাইরে বেরোনোর তাগিদে তৈরি হচ্ছিলাম। পাঁচিলে আমাদের বেড়ালদের আনাগোনা লেগেই থাকে। পর্দাটা নামাতে গিয়ে পাঁচিলে চোখ পড়ে গেলো এবং দৃশ্যতই চমকে উঠলাম। 

পাঁচিলে একটা বেড়াল বসে। গায়ের রঙ কালো। বুকের কাছটা সাদা, চারটে পায়ে সাদা মোজা, একটা পায়ে একটু উপর অবধি মোজার পরিধি। এক দৃষ্টিতে আমাদের জানালার পানে চেয়ে। কি ভীষণ চেনা ওর শরীরে রঙের সাযুজ্য। শুধু সাইজে সামান্য বড়ো। চীৎকার করলাম -"মা, শিগগিরি এস"। মাও দেখলাম কেমন চমকে গেলো। এতটা মিল কিভাবে হয়? ঠিক যেখানে যেখানে যতটুকু সাদা অংশ, ততটুকুই আছে।কালোতেও কোথাও গরমিল নেই একচিলতে। চলে যাচ্ছিলো। চুকচুক করতেই একবার ফিরে তাকালো। তারপর আবার আস্তে আস্তে চলে গেলো পাঁচিল দিয়ে। 

 আমি জানলা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। পাশ থেকে মায়ের অস্ফুট স্বর কানে আসলো -"আমরা এত ভালোবাসি, ভুতু ভুতু করছি, তাই দেখা দিয়ে গেলো। ওরা তো রূপ ধরতে পারে, এই বেড়াল তো আগে কখনও দেখিনি...."

সেদিন বিকেলের পর থেকে আজ অবধি বেড়ালটাকে আমি বা আমরা কোত্থাও দেখিনি। আমি জানি না, ও মৃত্যুর ওপার থেকে কোনও এক্টোপ্লাজমের সহায়তায় শরীর ধারণ করেছিল কিনা, আমি জানি না আমাদের ভালোবাসা এতটাই শক্তি ধরে কিনা, আমি কিচ্ছু জানি না। জানতে চাইও না। আমার প্রশ্ন একটাই। আমার এই জটিল সুকৌশলী চড়াই-উতরাইময় জীবনে ক্ষণিকের নরম, সুবজ আর্দ্রতা নিয়ে যখন এসেইছিলি রে ভুতু, তখন এত অল্প সময়ের জন্য কেন রে? 

আত্মা নাকি অবিনশ্বর। কিন্তু নিখাদ ভালোবাসা বোধহয় জীবন-মৃত্যুর কালান্তক সীমারেখা পেরিয়েও সত্য অবিচল থাকে। 

{গল্পের প্রতিটা শব্দ সত্যি}


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours