শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ:

সম্ভবত তোর তখন সতেরো কী আঠারোর শুরু। তোর সামনেই খামটা খুললাম। আর কখনও এমন করিসনি। কিন্তু সেদিন তুই কেন জানি চেকটা হাতে নিলি। আমি অন্য কী কাজে যেন হাত লাগালাম।

মা, এই টাকাটা না নিলে হয়না ?

(চোখ তোর ছলছল করছিলো)। আমি তোর দিকে তাকাতেই তুই আবার বললি, মাত্র তো পাঁচশ টাকা। এই টাকায়, কী হয় মা!

তোর কান্নায় আমার তো কষ্টই হবার কথা, কিন্তু না আমার হলো উল্টো। 

কী এক অজানা ভালো লাগায় আমার গায়ের লোম শির শির করে উঠলো। জাতীয় সংগীত শুনলেও আমার এমন হয়, আর বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। আজও তেমনি কান্না আসছিলো কিন্তু যতোটা সম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।

বাপ, এ তো টাকা নয় রে। এর নাম শাস্তি!

শিউলী আর ডলি আপা জানেন আমি মামলা করতে চাইনি। তবু বড়ো ভাইদের কথা ছিলো, "ওকে কতো আর ছেড়ে দেবে!"

টানা আড়াই বছর মামলা টেনে অবশেষে রায় হলো। ছেলের আঠারো আর মেয়ের একুশ পর্যন্ত পাঁচশ টাকা করে দু'জন একহাজার টাকা পাবে। এই টাকা ওই জানোয়ারটা স্বেচ্ছায় দেয়নি। মামলার রায়ের কপি ওর অফিসে জমা দিলে বেতন থেকে কেটে, ওটা আমার ঠিকানায় চেক হয়ে আসতো।

বাবা রে, এর পরিমান যদি এক টাকাও হয় তবুও সেটা শাস্তি, তবুও সেটা লজ্জা !

তারপর তোকে বুকে জড়িয়ে সেদিন খুব কাঁদলাম। আমরা দুজন একা, কোথাও কেউ নেই আমাদের। তোর কেমন লেগেছিলো জানিনা, কিন্তু সেদিন মনে হলো, আমার মতো সুখী মা বুঝি জগতে আর কেউ নেই, কোথাও নেই।

প্রায়ই আমাকে শুনতে হতো, ওই জানোয়ারটা নাকি তোদের খরচ দেয়। রাগে আমার খোলা রাস্তায় খিস্তি আওড়ানোর ইচ্ছেকে দমিয়ে বলতাম, আমি প্রমাণ করতে পারবো, সে দেয় না। আপনারা তাকে বলবেন প্রমাণ করতে যে, সে টাকা দেয়। অথবা সন্তান তো আমার কাছে রেখেই চোরের মতো সব নিয়ে পালিয়েছে, ওদের জিজ্ঞেস করবেন। কিন্তু আর এসব ব্যাপারে আমার সাথে কথাই বলতে আসবেন না। তবু ক্ষত নিয়েই কথা বলতে আসে মানুষেরা। বিকৃত বিনোদন।

তোর এখনও পড়া শেষ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই নাট বল্টু নিয়ে পড়ে থাকতি ঘন্টার পর ঘন্টা। তুই যে একটা মানুষ আছিস ঘরে, ঘন্টার পর ঘন্টা, বাইরে থেকে বোঝারই উপায় ছিলো না। আমার কলিগরা বলতেন, তোর মতো কুড়িটা বাচ্চা থাকলেও থাকি পালতে কষ্ট হতো না। মাত্র দুইটা বাচ্চা পালতে কিন্তু আমার বড়ো  কষ্ট হয়েছিলো রে বাপ! আমার নিয়তি অন্যরকম যেন। পাঁচ'শ টাকা দামের জামা জুতোয় তোর একটুও আনন্দ নেই। সব আনন্দ তোর গাড়িতে। খেলনা গাড়িতেই, সে হোক বিশ টাকার। আমিও আমার সাধ্যের ভেতর গাড়ি কিনতে আলসামো করিনি রে বাপ! কিনে আনার পর পরই তোর সেটা যতো দ্রুত হোক ভাঙ্গতেই হবে। তোর ছোট্ট অপুষ্ট শরীরের শক্তি মাঝে মাঝে হার মানতো। পারতি না ভাঙ্গতে। রান্নাঘরে আমাকে এসে বলতি, "মা বটি দিয়ে কেটে দে"! কী আর করা, টাকা দিয়ে গাড়ী কিনে বটি দিয়ে কাটো। আমার খারাপ লাগতো না।আমার তখনই মনে হতো, বড়ো হলে এর প্রভাব খারাপ হবে না, বুঝি তুই ইঞ্জিনিয়ার টাইপের কিছু একটা হবি। বুঝি তুই সাহসীও হবি। না, আমার স্বপ্ন বৃথা যায়নি। বড়ো স্বপ্ন আমি দেখতেই শিখিনি। আমার ছোটো স্বপ্ন যেন একটু বড়ো করেই পূরণ করলি তুই। পড়ছিস সিএসই। কিন্তুু তুই ড্রোন বানাতে শিখলি একাই। আমি তো থ ! আমার ছেলে কত্তোবড়ো বৈজ্ঞানিক গো! ভার্সিটির বড়ো ভাইরা তোকে কতো কতো আদর যত্ন করে। একটু আধটু কাজের অর্ডার পেয়েই তোর খুশীর সীমা নেই, সাথে আমারও। ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ বানিয়ে এক দেড়'শ টাকার জন্য শহরের এমাথা ও মাথা প্রচন্ড গরম আর জ্যামের মধ্যেও কী ভীষণ ছোটাছুটি তোর। ঘরে ঢুকেও স্বস্তি নেই। গুদাম ঘরের মতো একটা ঘরে থাকতে হয় তোর। জানালা নেই। ছাদের গরম।চার্জার ফ্যানটাও নষ্ট হয়ে আছে ম্যালাদিন। ঠিক করবো করবো করেও ঠিক করা হয় না। কোনটা রেখে কোনটা ঠিক করবো! আমাদের আস্ত জীবনটাকেই একটা পুরুষ ট্রাক গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে সেই কবেই ! বিচার পাইনি ক্ষতিপূরণও না। তোকে পালতে আমার কিন্তু কষ্ট হয়েছিলো খুব। জন্মগত অপুষ্টি, শুরুতেই ১০৫ ডিগ্রী জ্বর, শ্বাসকষ্ট, আর্থিক টানাটানি এসব নিয়ে একাইতো এতোদূর! কষ্ট  হবে না!

 তবু আনন্দ যে কম নেই রে বাপ!

এইতো মাত্র সেদিন। আমি হাসপাতালে। তুই ফল, মশারি আনলি তোর টাকায়। আমাকে ১০০০ টাকা দিলি। অনেক জোর করেই। তোর ঐ হাড় জিরজিরে শরীরের রোজগার নিতে আমার খুব মনে কষ্ট লাগছিলো। ড্রোনের সামান্য পার্টস ঠিক করে দিলে তোর ভার্সিটির বড়োভাই তোকে দিলো। আমি কখনও সন্তানের রোজগার খাবো, এটা ভাবতে শিখিনি। আমার কেবল ভাবনা তোদের সৎপথে স্বাবলম্বী হওয়া।আজ বললি, মা এ আমার প্রথম রোজগার, নিতেই হবে। তারপর তো না নিয়ে পারিনি। রাতে মশারির নিচে শুয়ে আমার আনন্দে ঘুম আসছিলো না। হাসপাতালের বেডকে আমার সাগরপাড়ের বাংলো মনে হচ্ছি। যদিও অমন ঘরে থাকাই হয়নি আমার! তাতে কী, সমুদ্রের স্বাদের নীলা যে আমার খুব চেনা। নীলাকে তুই চিনবি না। এই প্রজন্ম নীলাকে চেনে না। আমিও চিনতাম না। আমার বাবা আমাকে চিনিয়েছিলেন। আমি অন্যদের মতো পারিনি। কিন্তু যেটুকু পেরেছি তাতেই আমি ধন্য। আমার সন্তান মানবিক মানুষ হয়েছে, এটাই আমার কাছে অনেক। আমিতো জানি তুই কতোটা নীচতার ভেতর থেকে বেড়ে উঠেছিস! কতোটা টানাপোড়েনের মাঝে তোর বেড়ে ওঠা। তোর মামাতো ভাইয়েরা প্রায়ই মুরগী খেতো, বড়ো বড়ো টুকরা, মাছও অমনি। অথচ তারা নিজেদের রোজগার খেতো না। সে অন্য গল্প, আপাতত যাই না সেদিকে। মাঝে মাঝে ওদের খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিতিস। এখনও পারি না তোকে ভালো খাবার দিতে, কিন্তু তা নিয়ে তোর কোনো ক্ষোভ নেই। এমনও দিন গেছে টানা পনেরো দিনের মতো আমরা তিনজন শুধু হেলেঞ্চা শাক ভাজি দিয়েই ভাত খেয়েছি। তোদের  কোনো অভিযোগ ছিল না।

ভাবছিস আজ কেন এতো কথা! কারন তো আছেই। আঠারো বছর পর আমি আবার আঠারো বছর আগের কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে গেলাম। আবার দেখা পেলাম এক পিতার, অনেকটাই তোদের পিতার মতোই। সেও অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে তুচ্ছ করে দিলো এক মা আর তার সন্তানের জীবন। এই মা তোর মায়ের মতো স্বাবলম্বী না। ছেলেটার ভবিষ্যৎ কী হবে এই পিতাও ভাবেনি। তোদের পিতার মতোই চোরের মতো পালিয়েছে। কিন্তু এই মা স্বাবলম্বী  না হলেও আমার মতো অসহায় নয়। এই মায়ের পিতা আছে, ভাইও আছে। আমার পিতা ছিলো না, ভাইয়েরা আছে বলতে ইচ্ছে করেনি কখনও। এই মেয়ের পিতা বলেছে, "আমার মেয়ের পনেরো বছরের যন্ত্রণার হিস্যা আমি নিয়েই ছাড়বো!"

তুইই এখন আমার পিতা।



 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours