সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপর:
কথিত আছে "অভাগা যে দিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়"। হ্যাঁ সত্যিই আমরা মনুষ্য জাতিরা আজও বড্ড অভাগা। আর তা না হলে কি এই মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারণে একটা সাগর আজ বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হয় কখনো !! একসময় যে জলরাশিতে ছিল প্রাণের প্রাচুর্য, সেই জলরাশির প্রাণ প্রবাহ, আজ তাহলে কি করে শুকিয়ে গেল ? সে কি কালের কোন নিয়মে? নাকি সত্যি সত্যি মানুষের নির্বুদ্ধিতায়?
জানি এ রকম প্রশ্ন আপনাদের মনেও জাগতে পারে, তাই চলুন আজ আমরা এমনই এক সাগরের শুকিয়ে যাওয়ার কিছু গল্প শুনি।
নামে এটি সাগর হলেও, আসলে "আরাল সাগর" মূলত একটি হ্রদ। বিশালতার কারণে আরবদের কাছে এটি সাগর নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এটি কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তান এর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এই হ্রদটির আয়তন ৬৭ হাজার বর্গ কি.মি.। এর গড় গভীরতা ৪৬ থেকে ৪৯ ফুট। সর্বাধিক গভীরতা ৩৩৫ ফুট ও পৃষ্ঠতলীয় উচ্চতা ১৭৫ ফুট। এই আরাল সাগরের তীরেই অবস্থিত সবুজে ঘেরা মোইনাক শহর। যা পরবর্তীতে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের হিসাব অনুযায়ী এই আরাল সাগরের প্রায় ৭০ শতাংশ শুকিয়ে গেছে। যেখানে ৫০ বছর আগেও এই আরাল সাগর ছিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ। কাস্পিয়ান সাগর, লেকস সুপেরিয়র ও ভিক্টোরিয়ার পরেই ছিল এর স্থান। এই আরাল সাগরের বয়স প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন বছর। এই আরাল সাগরের সাথে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলো। সাগরটি শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানকার ভূ-অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
একসময় আরাল সাগরের তীরবর্তী এলাকার আবহাওয়া মোটেও বসবাসের জন্য উপযুক্ত ছিল না। সে সময়ে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল মাত্র ১০০ মিলিমিটার। যা, যে কোনো প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রতিকূল। তা ছাড়া এ সময়ে এর প্রতি লিটার জলে লবণের পরিমাণ ছিল গড়ে ১০ গ্রাম। ফলে হাতেগোনা কয়েকটা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বেঁচে থাকতো সেখানে। আর সেইসব মাছেদেরকে ঘিরেই আরালের বুকে গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র মৎস্যশিল্প। সে সময় মাছ শিকারীদের নৌকায় মুখরিত হয়ে থাকত আরাল সাগর।
তবে স্বার্থপর মানুষের লোভে একসময় বিনাশ হওয়া শুরু হয় এই হ্রদের। তবে সাগরটি শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল খলনায়ক ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯১৮ সালে গড়ে তোলা সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন তুলো শিল্পের সফলতা ছিল শীর্ষে। তাই সোভিয়েত সরকার বিশ্ব বাজারে তুলোর চাহিদাকে ধরে রাখতে সেখানে তুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নেয়।
সির দরিয়া এবং আমু দরিয়া, এই দুই নদীর জলকে তুলো ক্ষেতে সেচের কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়। অনুর্বর মাঠকে উর্বর করতে তাই নদীর দিককে পরিবর্তন করে তারা। এজন্য দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে নদীর জল টেনে এনে তুলো চাষ অঞ্চলের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। ফলে আরাল হ্রদের দিকে ধাবিত হওয়া জলের পরিমাণ কমতে থাকে। হ্রদের সঙ্গে কোনো সাগরের সংযোগ না থাকার কারণে আস্তে আস্তে সেখানে জলের পরিমাণ কমে যায়। অথচ সোভিয়েত সরকার তখন কিন্তু সেদিকে একবারও ভ্রুক্ষেপ করেননি।
দিনের পর দিন জলের পরিমাণ কমতে থাকায় হ্রদের জলে লবণের ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়। এক সময় সেই লবনের পরিমান হয় প্রতি লিটার জলে ১০০ গ্রাম। ফলে জলজ প্রাণীদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকে। আর সেই থেকেই শুরু হয় আরাল সাগরের ধ্বংসের সূচনা। লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে আবহাওয়ার বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে সেসময় ঝড়-তুফানের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণ। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণাগারের রাসায়নিক বর্জ্য, বিষাক্ত কীটনাশক, শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও তুলো উৎপাদনে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশক ও সার এই সময় আরাল সাগরে নিষ্কাশন করা হতো।যার ফলে বিভিন্ন দীর্ঘ স্থায়ী অসুস্থতা, যেমন- ক্যান্সার, বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি, শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন সংক্রমণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনই কমে গিয়েছিল রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। যার ফলে এই সময় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে দেখা গিয়েছিল। এই কারণে মোইনাকে খাদ্যনালির ক্যান্সারের হার বিশ্বের গড় হিসেবের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি। যা অতিশয় বেদনাদায়ক।
১৯৬০ সালের এই বিশালাকৃতি হ্রদের জল দ্রুত শুকিয়ে যেতে শুরু করার বিষয়টি স্থানীয় অধিবাসীরা লক্ষ্য করেন এবং তারা কোন উপায় না দেখে অন্য প্রদেশে চলে যেতে শুরু করেন। ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে করা জরিপ অনুযায়ী আরাল সাগরের প্রায় ৯০ শতাংশ জলই তখন শুকিয়ে গেছে। আর জলের প্রবাহ কমতে কমতে এক সময়ের এই বিশাল আরাল সাগর সামান্য জলাশয়ে পরিণত হয়। ২০১৪ সালের নাসার প্রকাশিত উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায় যে, হ্রদটির পূর্বাঞ্চলীয় বেসিনের পুরোটাই শুকিয়ে গেছে। যে অঞ্চলটি এখন আরালকুম মরুভূমি নামে পরিচিত।
আরাল সাগরের দক্ষিণভাগ এখনও মরুভূমির মতো শুষ্ক। তবে একটু হলেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে তার উত্তরাংশকে ঘিরে। এই উত্তরাংশ ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে তার জীবনপ্রবাহ। যে মানুষেরা তাদের নির্বুদ্ধিতায় এক সময় তার বিনাশে মেতে উঠেছিল আজ তারাই আবার তার জীবন দানে সহমর্মী হয়ে উঠেছে । ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটার পর আরাল সাগর নতুন রাষ্ট্র, অর্থাৎ কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের অধীনে চলে আসে। আমরা সাগর বলতে যা বুঝি, তার কোনো অস্তিত্বই তখন ছিল না। কেবল মাত্র ১০ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে জল অবশিষ্ট ছিল।
আরাল সাগরের বিপর্যয়ের কারণে পুরো অঞ্চলের আবহাওয়ার উপর প্রভাব ফেলেছিল। তাই দুই দেশের নেতারা তখন একত্রিত হয়ে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেন। এই সময়ে ঠিক হয় লম্বা খাল খনন করে দক্ষিণে সাগর থেকে জল আনার প্রচেষ্টা করা হবে। প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সে সময়ে কোটি কোটি ডলার লোকসান হয়। ফলে শেষমেশ পুরো প্রকল্পটিই বাতিল করে দেওয়া হয়।
এরপর ২০০৩ সালে কাজাখস্তান সরকার ঘোষণা করেন যে, বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পুনরায় নদীর জল আরালের দিকে প্রবাহিত করা হবে। কিন্তু উজবেকিস্তান সরকারের সঙ্গে সেই প্রকল্পের বিভিন্ন ইস্যুতে একমত না হতে পারায় পুরো আরাল জুড়ে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্পটিও স্থগিত হয়ে যায়।
তবে কাজাখস্তান সরকার তখন বসে না থেকে নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে কাজাখস্তান সীমানায় বাঁধ নির্মাণ শুরু করার নির্দেশ দেন। ২০০৫ সালের দিকে সেই বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। বাঁধের কারণে কাজাখস্তান অঞ্চলে আরাল সাগরের পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নতি হয়। হ্রদে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তর আরাল সাগরে মাছ চাষ শুরু হয়। কাজাখস্তানের এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে উজবেকিস্তানের বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে আসেন। কিন্তু জলের অধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় কেউই সমঝোতায় আসতে না পারায় এই প্রকল্প বেশিদূর এগোয়নি। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক এই কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কাজাখস্তান সরকারকে ৬৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করা ছাড়াও প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নেয় বিশ্বব্যাংক।
২০০৮ সালে দ্বিতীয় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পুনরায় উত্তর আরাল সাগরে জলের প্রবাহ শুরু হয়। কাজাখস্তান বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলকে পুনরায় আনতে সক্ষম হলেও, গবেষকদের মতে, আরাল সাগরের জলের স্বাভাবিকতা আর কখনোই সম্পূর্ণরূপে ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো সমঝোতায় না পৌঁছালে আরাল সাগরের বাকি অঞ্চলগুলোয় কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না। যদিও হ্রদটির উত্তরাংশ তার মূল আকারের ১৮ শতাংশ ফিরে পেয়েছে তবুও আরাল সাগরের সেই প্রাচীন রূপ আর হয়ত কোনোদিনও সে আর ফিরে পাবে না।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours