পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
স্কুলের মধ্যে অশ্লীল তামাশায় মগ্ন ক্লাস এইটের তিন ছাত্র, তাদের সামনে এসে দাঁড়াল অপর এক সহপাঠী। দু একটি কথার পরই হঠাৎ একটি হাতুড়ি বার করে আক্রমণ হানল সে। ঠান্ডা চোখে, শীতল রক্তে একের পর এক তিন জন সহপাঠীকে ওই হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে খুন করল সে। বার বার সেই আঘাতে থেতলে যাচ্ছে তাদের মাথা, বের হয়ে আসছে রক্ত-ঘিলু, ছটফট করছে কিশোরের দল। আবার সে হাতুড়ি তুলল উপরে, এবারে বোধ হয় মোক্ষম আঘাত… আর না, এবার থামাতে বাধ্য হলাম। এই হিংসা নেওয়া মুশকিল। এত প্রাঞ্জল ভাবে এই হিংসা দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যে আমার পক্ষে আর পুরোটা দেখা সম্ভব হল না।
এটি সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ওয়েব সিরিজের দৃশ্য। বাস্তবোচিত করতে গিয়ে খুনটিকে এতটাই বীভৎস করে দেখানো হয়েছে যে সুস্থ রুচিতে তা দেখা বেশ মুশকিল। হ্যা এখানেই একটা বিতর্ক শুরু হতে পারে, রুচি। কার কেমন রুচি সেটা ঠিক করবার কোনও অধিকার আমার নেই, থাকা উচিতও নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মনে এসেছে বাস্তব মানেই কি তা অতি বীভৎস, অতি অশ্লীল করে পরিবেশনা? ভারতীয় ওয়েব সিরিজের বয়স কিন্তু খুব কম নয়, তা বছর ছয়েক তো হবেই। গুগলের মতে ২০১৪ সালে টিভিএফের পার্মানেন্ট রুমমেট ভারতে ওয়েব সিরিজের জনক। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত অসংখ্য ওয়েব সিরিজ রিলিজ করেছে। কিন্তু ওয়েব সিরিজের সব চেয়ে বাড় বাড়ন্ত এই লক ডাউনের সময়। এক্ষেত্রেও গুগল জানাচ্ছে লক ডাউন পিরিয়ডে নতুন পুরনো নানা ওয়েব সিরিজ দেখেছেন সিংহ ভাগ মানুষ। এই সময়ে নতুন সিনেমা খুব বেশি রিলিজ করেনি, কিন্তু ওয়েব সিরিজ মুক্তি পেয়েছে, তাই মানুষ ওয়েব সিরিজকেই বেছে নিয়েছেন। ওয়েব সিরিজও মানুষকে হতাশ করেনি। বরং কিছু ক্ষেত্রে তারা সাধারণ সিনেমার চাইতেও বেশি কিছু দিয়েছে দর্শকদের। সেক্রেড গেমস্, মির্জাপুর, স্পেশাল ওপস্, দি ফ্যামিলিম্যান, বারড অফ ব্লাড, অসুর প্রভৃতি ওয়েব সিরিজগুলি ভারতে এক একটি মাইল ফলক স্থাপন করেছে। এদের বিষয় ভাবনা, চরিত্র নির্বাচন, অভিনয় সব কিছুই স্বকীয়তার কারনে দর্শক প্রশংসিত হয়েছে। বেশ কিছু ওয়েব সিরিজের বিষয় ভাবনার ক্ষেত্রে রীতিমত গবেষণার ছাপ মেলে। এমনকি পরিচিত বা প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের না নিয়েও শুধু মাত্র অভিনয় এবং বিষয় অভিনবত্বের কারনে বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ প্রশংসা পেয়েছে।
কিন্তু… বাস্তবতা দেখাতে গিয়ে ওয়েব সিরিজগুলি একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলছে বলে অভিযোগ অনেকের। প্রায় সিংহ ভাগ ওয়েব সিরিজেই অশ্লীল গালিগালাজের ছড়াছড়ি। অধিকাংশই বাড়ির অন্যদের সামনে বসে দেখা মুশকিল। চুম্বন, নগ্নতা নিয়ে কথা না বলাই ভাল, সেক্ষেত্রেও নানা মুনির নানা মত। কিন্তু চরিত্র চিত্রণ বাস্তবোচিত করতে গিয়ে মা বোনেদের জড়িয়ে অনাবশ্যক এমন গালি(পড়ুন খিস্তি) খুব প্রয়োজনীয় কি? ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হল এখনও তা সেন্সর বোর্ডের আওতায় আসেনি। আর এটাই সব চেয়ে বড় অসুবিধাও। মানছি সেন্সর বোর্ড মাঝে মধ্যে বেশ একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে, অনধিকার চর্চাও করে বসে। কিন্তু তাও একটা লাগাম থাকে। আমরা যেমন এখনও এই প্রাপ্ত বয়সেও বাবা মাকে সম্মান করি, তাদের সম্মান দিতে তাদের অনেক কথাই মেনে চলি তেমনটা আর কি। কিন্তু ওয়েব সিরিজ সকলেই মুক্ত, অনাথ, তাদের মাথার উপরে কোনও অভিভাবক নেই। সেক্ষেত্রে অনুশাসন না থাকার ফলে বখে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। তাই ভাল কনটেন্ট থাকা স্বত্বেও পরিবারের সকলের সঙ্গে বসে সিংহ ভাগ ওয়েব সিরিজ দেখাই বেশ চাপের।
তা স্বত্বেও বলব, ভারতীয় ওয়েব সিরিজ তার স্বকীয়তার জেরে বিদেশেও জনপ্রিয় হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষও এখন চেটেপুটে উপভোগ করছেন বিভিন্ন স্বাদের ওয়েব সিরিজ, তবে তাদের অধিকাংশই যুব বা মধ্য বয়স্ক। কিন্তু সেটাই একটু কোমল ভাবে পরিবেশিত হলে তার দর্শক সংখ্যা কমে যাবে বলে তো মনে হয় না। বরং আরও বিভিন্ন বয়সের দর্শক বাড়বেন বলেই আশা করা যায়। আবারও বলছি নগ্নতা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে সেটি শ্লীল না অশ্লীল। কিন্তু খিস্তি যে শ্লীল নয়, সেটা নিয়ে কারও নিশ্চয় দ্বিমত থাকতে পারে না। ওয়েব সিরিজের পরিচালকেরা একটু ভেবে দেখতেই পারেন। না কি অতি বাস্তবতা, সেটার অনুমোদন দেয় না?
Post A Comment:
0 comments so far,add yours