রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

"এসেছে শরৎ হিমের পরশ

লেগেছে হাওয়ার পরে

সকাল বেলায় ঘাসের আগায়

শিশিরের রেখা ধরে।"

১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২০ সাল, "মহালয়া" অর্থাৎ পিতৃপক্ষের অবসান এবং দেবীপক্ষের সূচনা| আকাশে বাতাসে শরতের ছোঁয়াচ লেগেছে "মা" আসছেন|

এই যে সময়কাল তা আপামর বাঙালীর জীবনের একটা স্নিগ্ধতা এনে দেয়| জীবনে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মহালয়ারও পরিব্যাপ্তি ঘটেছে|

আমাদের ছোটোবেলায় তখন  Black & White টেলিভিশন ছিল| এই মহালয়ার দিন ভোরবেলায় মা ঘুম থেকে তুলে দিত দূরদর্শনে মহালয়া দেখার জন্য| তার আগে মা ঘুম থেকে উঠে ঘরে ধূপ-প্রদীপ জ্বালিয়ে শঙ্খ বাজাত| ঐ দিন ভোর থেকেই নদীর ঘাটে তর্পণ করা হয় পিতৃপুরুষের জন্য|

যখন Primary school এ পড়তাম তখন এই ভোরবেলায় দেখা মহালয়ার রেশ সারাদিন বয়ে নিয়ে বেড়াতাম| ঐ দিন স্কুল ছুটি ফলে আমার বয়সি সবাই মিলে মহালয়ার পর্ব চলত সারাদিন ধরে| সেইদিন থেকেই প্রায় আমাদের পুজোর ছুটির আমেজ শুরু হয়ে যেত| প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধা হয়ে যেত আর সেখানেই চলত আমাদের হুটোপুটি। 

ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম, High School। উঁচু ক্লাস| তখন মহালয়ার দিন খুব কষ্ট হত, সেই সময় আমাদের Half Yearly পরীক্ষা শেষ হত চতুর্থীর দিন| তাই পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুজোর আনন্দটা ঠিকভাবে উপভোগ করতে পারতাম না। কারণ বেশী কষ্ট হত এইজন্য যে স্থানীয় CD-এলাকার পুজো প্যান্ডেলের পাশ দিয়েই আমাদের স্কুল যেতে হতো| রোজই দেখতাম প্যান্ডেল গুলো একটু একটু করে বড় হচ্ছে, তাই মনে মনে খুব রাগ হত| পরবর্তীকালে অনেক চ্যানেলে মহালয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু দূরদর্শনের মহালয়ার আকর্ষণ ছিল আলাদা|

এরপর ধীরে ধীরে মহালয়ার সেই ছোটোবেলার আনন্দটা মলিন হয়ে যেতে থাকলো| পড়াশোনা--তারপর চাকরি, সবকিছু সময়ের সাথে সাথে অনেক ফিকে হয়ে যেতে লাগলো|

তবে মায়ের সেই অভ্যাসটা আমিও করি| ঐ দিন ভোরবেলা উঠে ধূপ-প্রদীপ জ্বালিয়ে শঙ্খ বাজিয়ে তারপর মহালয়া দেখতে বসি| আসলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই গুরুগম্ভীর শব্দোচ্চারণ যেন কানে অনুরনণ ঘটে|

মহালয়ার কথা বলতে বলতেই আজ ছোটোবেলার অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল| আমাদের সময়ে National চ্যানেলে "রামায়ণ" পরে "মহাভারত" হত রবিবার দিন আর ঐ সময়টা রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা থাকতো|

গ্রীষ্মকালে রবিবার ছুটির দিনে ঘরে এবং শীতকালে ছাদে বাবা আমাদের দুই বোনকে শ্রুতিলিখন করাত "আমরা বাঙালী", "মনিষীদের জীবন কথা" প্রভৃতি বই থেকে| দুই বোনের মধ্যে Competition চলত কে আগে শেষ করতে পারবে| আর যে আগে শেষ করতে পারবে সে একটা Pen পাবে| সেই সময় একটা Pen গিফট পাওয়া খুব মূল্যবান বিষয় ছিল| বাবা বলত "Pen is a power and Pen is a weapon" তখন মানেটা বুঝতাম না| কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম Pen কত মূল্যবান বস্তু|

তারপর থেকেই বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ল, "শুকতারা", "আনন্দমেলা"| বেশীর ভাগটাই শেখর কাকু ( Amalendu Ghosh বর্তমানে ব্যান্ডেলে থাকেন) এনে দিত এই সব বইগুলো| পরবর্তীতে "সঞ্চয়িতা", "সঞ্চিতা" এই বইগুলো এনে দিয়েছিল এবং আবৃত্তি বিষয়টাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল।

আর আজ আমি একজন বাচিক শিল্পীর পরিচয় পাই যা আমার কাছে খুব গর্বের|আরেকজনের কথা না বললেই নয় পিন্টুকাকু (প্রদীপ সরকার) বর্তমানে দুর্গাপুরেই থাকেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমাকে শরৎচন্দ্র এবং বিভূতিভূষণ সম্পূর্ণ ভাবে পড়তে দিয়েছিলেন|

আমাদের তখন ঝুলনের সময় প্রত্যেকের বাড়ীতে ঝুলন সাজানো হত| আমরা Quarters এ থাকতাম তাই যারা বড়রা ছিল তারা Quarters এর নীচে সিঁড়ির গলিতে ঝুলন সাজাত| আমরা সবাই আবার সন্ধ্যেবেলায় ঝুলন দেখতে যেতাম, প্রসাদে নকুলদানা দিত| মাঝখানে বয়ে গেছে বেশ কিছু সময়। আজও Quarters এ থাকি। আজও ঝুলন চোখে পরে। কিন্তু সেই ফেলে আসা আনন্দটা আর যে পাই না। 

আর একটা খুব আনন্দের বিষয় ছিল সরস্বতী পুজো| মা সকালবেলায় নিম-হলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিত, তারপর শাড়ী পরে পুজোতে যাওয়া| বাড়ীতে পুজো থাকা সত্বেও আমাদের বাড়ীর পাশেই ছিল প্রাইমারী স্কুল সেখানে যেতাম পুষ্পাঞ্জলি দিতে| স্কুলে বড়দি অনিমা মল্লিক (প্রয়াত) সবাইকে সুন্দর করে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিতেন|

তবে সরস্বতী পুজোর সময় আর একটা মজার ব্যাপার ছিল ফুল চুরি হওয়া আর বাগানের বা সিঁড়ির বাল্ব চুরি হওয়া| আমাদের সামনের Quarters এ ছিলেন কানাই চক্রবর্তী কাকু আর দুলাল দাস কাকু। দুজনেই খুব সুন্দর করে বাগান সাজাত| শীতকালে বিভিন্ন রকমের ফুলের সমাহার ছিল কাকুদের বাগানে| ফলে সরস্বতী পুজোর আগেরদিন প্রায় সারারাত জেগেই বাগান পাহাড়া দিত| আর সবাই বাল্ব খুলে রেখে দিত ঘরে ঐ দিন। না হলে সকাল বেলায় উঠে তাকে আর পাওয়া যাবে না, আর বোঝাও যাবে না ঐ বাল্ব কোন প্যান্ডেলে আলো প্রদান করছে|

তারপর যখন High School এ গেলাম তখন (আমাদের M.A.M.C Girl's High School) শাড়ী পরে বন্ধুদের সাথে স্কুলে যাওয়া, প্যান্ডেলে ঘোরা এসব ছিল| কিন্তু বাড়ী থেকে তার জন্য সময় নির্ধারণ (Time limit) করা থাকত যে ঐ সময়ের মধ্যে বাড়ী ফিরতে হবে তাই লুকিয়ে কোথাও যাওয়ার সাহস করতে পারিনি|

১৫ আগষ্ট, ২৬ জানুয়ারি এই দিনগুলোও খুব সৌন্দর্য সহকারে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হত আমাদের টাউনশিপে|

স্মৃতির ঝুলি থেকে এই কথাগুলো লিখতে লিখতে একটু কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে এত তাড়াতাড়ি সব চলে গেল কেন? কেমন জানি স্মৃতিময় চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কলম যে সরতে চাইছে না...



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours