সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

যার সৃষ্টি আছে, তার তো ধ্বংসও অবধারিত। সে মানুষই বলুন আর সমাজই বলুন বা পৃথিবী, ধ্বংস তো নিশ্চিত। আজ যেমন সারা বিশ্ব জুড়ে  উষ্ণায়নের ফলে প্রকৃতি তার ভারসাম্য দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। তেমনই আমরা যারা সভ্য সমাজে বাস করি তারাও হারিয়ে ফেলেছি আমাদের মানসিকতাকে। প্রকৃতি তার ভারসাম্যতা হারাচ্ছে বলেই এখন যেমন অসময়ে বন্যা কিম্বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় লেগে থাকছে। তেমনই মানুষের ভারসাম্য হীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের বিচার বুদ্ধিও। এখন যেমন গ্রীষ্মকাল পড়তেই আমরা দেখতে পাচ্ছি চরম জল সংকটকে, তেমনই দেখতে পাচ্ছি এই সমাজে প্রকৃত মানুষের অভাবকেও।

বিজ্ঞানীদের মতে ২০৫০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্ব জুড়ে দেখা দিতে পারে তীব্র জল সংকট। তখন মানুষের গলা তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও এক ঢোক জল পান করার কোন উপায় থাকবে না তাদের। এর জন্য অবশ্য আমরা নিজেরাই দায়ি। আমরাই তো আমাদের  নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পৃথিবী থেকে সবুজ বনানীকে কেটে সাফ করে দিচ্ছি দিনের পর দিন। প্রকৃতির সবুজকে ধ্বংস করে সেখানে আমরা গড়ে তুলছি কংক্রিটের দেওয়াল। আমাদের এতটাই দুর্বুদ্ধি, যে আমরা জলাশয়কেও বন্ধ করে তার উপর গড়ে তুলছি ইমারত।  আমরা কেউ-ই আমাদের ভবিষ্যতের কথা একবারও চিন্তা করছি না।

বর্তমানে আমরা নিজেরা এতটা ভোগ বিলাসিতায় মত্ত যে আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মের কথা কখনোই মাথায় আনছি না। সচেতন মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েও জলের অপব্যবহার এখনো পর্যন্ত বন্ধ করতে পারলাম না আমরা। যদিও এখন বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারতবর্ষে বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তবে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা তো সময়ই বলবে তাই না।

আচ্ছা ভাবুন তো কখনো যদি পৃথিবীটা জলশূন্য হয়ে যায় তবে কেমন হবে!! আমার তো এই কথাটা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। জানি না, আপনারা ভাবার পর আপনাদের কার কি অবস্থা হবে। 

তবে জলের অপব্যবহার এখনও বন্ধ না করলে ভবিষ্যতে চরম জল সংকট হবে তা বলাই বাহুল্য। আচ্ছা, যদি এমন কোন পুষ্করিণী আবিষ্কৃত হতো যেখানে জলের কোন অভাব হতো না তা হলে কেমন হতো বলুন তো...?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ আমি আপনাদের এমনই এক বিস্ময়কর প্রাকৃতিক জলের কুণ্ড বা ট্যাংক সম্পর্কে কিছু কথা জানাবো।

এই প্রাকৃতিক জলের ট্যাংক বা কুণ্ডটি আসলে ভারতবর্ষের মধ্য প্রদেশের ছত্রপুর জেলার বাজনা গ্রামের নিকট অবস্থিত। বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৭৭ কিলোমিটার। এই বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলটি ২০০৭ সালের পর থেকে চরম জলসংকটের মুখোমুখি হয়েছে। অথচ মাত্র ৭৭ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির কোলেই অবস্থিত এই কুণ্ডটি। এই কুণ্ডটির নাম ভীমকুণ্ড বা নীলকুণ্ড। এটি একটি প্রাকৃতিক জলের উৎস। এটি এত পুরনো যে এর উল্লেখ মহাভারতেও পাওয়া যায়। পৃথিবীতে এমন অনেক রহস্যের জিনিস আছে যেখানে বিজ্ঞানের উন্নতিও তার রহস্যকে ভেদ করতে পারে না। তেমনই এখনো পর্যন্ত এই ভীমকুণ্ডের গভীরতাকে মাপতে বা এর উৎসকে খুঁজে নিতে কেউই সক্ষম হয়নি।

প্রাচীন ভারতে এই জায়গাটি সাধনার জন্য প্রমুখ কেন্দ্র হিসেবে গণ্য ছিল। এখানে বড় বড় জ্ঞানী ঋষি মুনিরা তপস্যা করেছিলেন। বর্তমানে এই জায়গাটি একটি পর্যটন ও গবেষণার কেন্দ্রতে পরিণত হয়েছে।

পৌরানিক কথা অনুযায়ী ভীমকুণ্ডের কথা মহাভারতের সাথেও যুক্ত আছে। কৌরবদের সাথে হেরে যাওয়ার পর পাণ্ডবদের ১৩ বছরের জন্য নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। এই  নির্বাসনের সময় নাকি পাণ্ডবরা কেবল পর্বত ও বনের মধ্যে আশ্রয় নিতে পারতেন। নির্বাসনে যাওরার জন্য যখন পাণ্ডবরা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখন দ্রৌপদী তৃষ্ণার্ত বোধ করেন। এরপর পাঁচ ভাই মিলে ওই জঙ্গলে জলের খোঁজ করতে লাগলেন। কিন্তু  কোন উপায় না পেয়ে তখন তারা আবার হাঁটতে শুরু করলেন। এভাবে আরও কিছুটা পথ হাঁটার পর দ্রৌপদী সহ পাঁচ ভাইয়েরও পিপাসা যখন আরও বেড়ে যায়,  তখন ভীম কোন উপায় না দেখে ক্রোধে তার গদা দিয়ে ভূপৃষ্ঠের উপর সজোরে আঘাত করে। সেই আঘাতের ফলেই ওই স্থান থেকে জল বের হতে শুরু করে এবং দ্রৌপদী সহ পাঁচ ভাই সেই জল পান করে তাদের পিপাসা মেটায়। এর পর থেকেই এই জায়গাটির নাম হয় ভীমকুণ্ড।

এই কুণ্ডটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ মিটার নীচে অবস্থিত। আপনি যদি ভূপৃষ্ঠ থেকে এটিকে দেখেন তবে এটি দেখতে ঠিক গদার মতো বলে মনে হবে আপনার। এই কুণ্ডটি লাল পাথর দিয়ে ঢাকা। এই কুণ্ডকে ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের  রহস্য। চলুন, আজ আমরা সেই রহস্য সম্পর্কে কিছু কথা জানি।

রহস্য নম্বর এক:- অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও খননকারীরা ভীমকুণ্ডের আসল গভীরতা পরিমাপ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউই তা পেরে ওঠেনি। সময় সময় তারা ডুবুরি নামিয়েও চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয় নি। শুধু ব্যক্তি নয়,এই খবরটি যখন বিদেশি টিভি চ্যানেল ডিসকভারির কাছে গিয়ে  পৌঁছায় তখন 'ডিসকভারি' চ্যানেলের প্রতিনিধিরাও ডুবুরি এনে তাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাদের সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। তারা এই কুণ্ডের গভীরতা মাপার জন্য অত্যাধুনিক ক্যামেরাও ব্যবহার করেছিলেন, তবে, সেই ক্যামেরাকে ২০০ ফুটের বেশি নীচে নিয়ে যেতে পারেনি।

রহস্য নম্বর দুই:- আপনারা তো জানেন নদীতে কেউ যদি ডুবে মারা যায় তা হলে তার লাশ দু তিন দিন বাদে নদীর জলের উপরে ভেসে ওঠে। কিন্তু ভীমকুণ্ডে এমনটি  কখনো হয় না, এখানে এমনই বিচিত্র বিষয় আছে যে এখানে যদি কেউ ডুবে মারা যায় তাহলে তার লাশ কখনোই উপরে ভেসে ওঠে না বরং সেটি রহস্য জনক ভাবে অদৃশ্য বা গায়েব হয়ে যায়।

রহস্য নম্বর তিন:- প্রথমেই বলেছি এই কুণ্ডটা রহস্যে ভর্তি, এই কুণ্ড থেকে নাকি কোন বিপর্যয়ের আগাম সংকেত জানতে পারা যায়।  শোনা যায় কোন বিপর্যয়ের আগে নাকি এই কুণ্ডের জল আকস্মিক বেড়ে উঠতে শুরু করে। এমনও শোনা গেছে এখানে নাকি সুনামি ও ভূমিকম্পের সংকেত স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয়দের কথা অনুযায়ী ২০০৪ সালে যখন সুনামি আঘাত হানে তখন নাকি এর জলস্তর প্রায় ১৫ থেকে ৩০ ফুট উঁচুতে উঠেছিল। এখানকার স্থানীয় মানুষজন বলেন তারা নাকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা আগাম জানতে পারে। এই কুণ্ডের জলকে স্থানীয়রা পবিত্র জল হিসাবে মনে করেন। তারা মনে করেন কেউ যদি মকড় সংক্রান্তিতে এই কুণ্ডের জলে ডুব দেয় তা হলে তার শরীরের সমস্ত রোগ নিরাময় হবে এবং তার জীবনের সব পাপ দূর হয়ে যাবে।

রহস্য নম্বর চার:- আমরা সবাই জানি, যে, যে জায়গায় থাকে সে সেখানকার জায়গা সম্পর্কে বেশি ওয়াকিবহাল। তাই ওখানকার স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে জানতে পারা যায় এই ভীমকুণ্ডের জল নাকি কখনোই কমে না। ভরপুর মাত্রায় এর জল ব্যবহার করার পরেও এই কুণ্ডের জলস্তর একটুও কমে না। এর কারণও খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় নি। কেউ জানে না এর আসল গভীরতা । ভীমকুণ্ডের গভীরতা মাপার জন্য মাঝে মধ্যেই অনেক ডুবুরিকে সেখানে নামানো হয়েছে কিন্তু তাতেও যখন কোন সুরাহা পাওয়া যায় নি, তখন ওখানকার প্রশাসন ভীমকুণ্ডের জল খালি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পাম্প লাগিয়ে এই কুণ্ডের জল খালি করার যোজনা বানায়। এই ভাবে বেশ কিছুদিন ধরে পাম্পের সাহায্যে জল তোলার পরেও ভীমকুণ্ডের জলস্তর এতটুকুও নামে নি। ডুবুরি নামিয়ে অবশ্য একটা জিনিস জানতে পারা গেছে যে এই কুণ্ডের ৮০ ফুট নীচে তীব্র গতি সম্পন্ন উৎস দেখা গেছে যার যোগাযোগ হয়তো সমুদ্রের সাথে করা আছে বলে মনে করা হয়। এর নীচে যে দুটি কুণ্ড আছে তার একটি দিয়ে জল প্রবেশ করে তো আর একটি দিয়ে জল নির্গত হয়। হয়তো এই কারণেই এই কুণ্ডের জলস্তর একটুও কমে না।

ভীমকুণ্ডের জল খুব স্বচ্ছ হওয়ার কারণে এখানে  যখন সূর্যের কিরণ পড়ে তখন এখানকার জলে বিভিন্ন ধরনের রঙ দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া এখানকার জলে কোন জিনিসকে অনেকটা নীচ পর্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার জলের স্বচ্ছতার জন্য  তাকে মিনারেল ওয়াটারের সাথে তুলনা করা হয়। এই সব কারণের জন্যই ভীমকুণ্ডের রহস্যটা রহস্যই রয়ে গেছে।

কি ভাবছেন?  কি ভাবে যাবেন এই ভীমকুণ্ডে? 

তা হলে চটপট লিখে রাখুন। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

বিমানে যেতে গেলে:-  এখানকার নিকটবর্তী বিমানবন্দরের নাম হলো খাজুরাহো যা ভীমকুণ্ড থেকে ৯২ কিলোমিটার দূরে। খাজুরাহোতে পৌঁছে সেখান থেকে কোন ট্যাক্সি ভাড়া করে ভীমকুণ্ডে পৌঁছাতে পারেন। 

অথবা

ট্রেনে করে গেলে:- ভীমকুণ্ডের নিকটবর্তী স্টেশনের নাম চত্তরপুর। যা ভীমকুণ্ড থেকে ৭৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখান থেকেও আপনি ট্যাক্সি ভাড়া করে ভীমকুণ্ডে পৌঁছাতে পারেন।

মধ্য প্রদেশের ছত্রপুর জেলার বাজনা গ্রামের নিকট অবস্থিত ভীমকুণ্ড ছাড়াও ওড়িশার কেওঝর ও ময়ূরভঞ্জ জেলার মধ্যে সীমানা রেখার ঠিক উপরে বৈতরণী নদীর উপর একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত আছে যার নাম 'ভীমকুণ্ড'। শীতের সময় পিকনিক করার জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। ভুবনেশ্বর থেকে ট্রেনে করে এখানে যেতে পারেন। এর নিকট তম রেল স্টেশন হরিচন্দনপুর। যার দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার ও কেওনঝড় ৮০ কিলোমিটার এবং জাজপুর থেকে কেওনঝড় রোড মাত্র ১০ কিলোমিটার।

এবার আপনারাই ঠিক করুন কে কোথায় যাবেন, সেই মতো প্ল্যানিংও করে রাখুন। যদি দেখেন পরিস্থিতি সব ঠিকঠাক তবে এ বছরই আপনারা ঘুরে আসতে পারেন। আর হ্যাঁ, যেখানেই যান না কেন মনে করে মাস্ক আর স্যানিটাইজার নিতে ভুলবেন না যেন।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours