সুমিত তালুকদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, নৈহাটি, উত্তর ২৪পরগনা:

আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, চটকদার ও গালভরা স্লোগান – তোমার ছুটি, আমার নয়। এতসব লোক দেখানো আয়োজন করেও শেষরক্ষা হোলো না। দু লক্ষ টাকা অগ্রিম দিতে না পারার কারণে বছর ষাটের বৃদ্ধা লায়লা বিবির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে  অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোলো বেসরকারি হাসপাতাল ডিসান-কে। তিতিবিরক্ত স্বাস্থ্য কমিশন বাধ্য হয়ে ঘোষণা করে –ডিসান বন্ধই থাকা উচিত। লাইসেন্স বাতিল হওয়া উচিত। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০/৮/২০) এছাড়া পাশাপাশি পার্ক সার্কাসের এস এস চ্যাটার্জি নার্সিংহোমকেও তাদের বক্তব্য প্রসঙ্গে কমিশনের কাছে হলফনামা দিতে বলা হয়েছে। বাস্তবিকই করোনা সংকটকালে, কোভিড রোগীদের পরিষেবার ক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ব্যবসা করবে না, ঘোলা জলে মাছ ধরবে না – এমন ভাবাটা সত্যি অবাস্তব ও হাস্যকর। এখানে ধনী দরিদ্র বাছবিচার চলে না। আজ কর্পোরেট চিকিৎসা ব্যবস্থায় থলে ভর্তি টাকা নিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা কিনতে হবে। বারবার সরকারের তরফ থেকে, স্বাস্থ্য ভবনের তরফ থেকে অতিরিক্ত অগ্রিম না নেওয়া ও চিকিৎসার খরচ বেঁধে দেওয়ার কথা বলা হলেও তা কোনো অজ্ঞাত কারণে কার্যে পরিণত হয়নি। ফলত বাইপাসের ধারে অবস্থিত অধিকাংশ ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হাসপাতালগুলো নির্বিচারে অবলীলায় ব্যবসা করে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করলে রোগীর আত্মীয় স্বজনকে হেনস্থা করা হচ্ছে, রোগীর মৃতদেহ আটকে রাখা হচ্ছে, পুলিশ দিয়ে ও নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে বলপূর্বক বের করে দেওয়া হচ্ছে। এদের শাস্তি দেবে কে? যেখানে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে। এতসব করেও হুঁশ ফেরে না, এতটাই মজবুত এদের প্রভাব ও রাজনৈতিক যোগসাজশ। 

সম্প্রতি সৌরভ দত্ত “হাসপাতালে খরচ, দেখা নেই তালিকার।“ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখলেন – “স্বাস্থ্য কমিশনের পরামর্শই সার। ...শহরের একাধিক কর্পোরেট হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেল, সেই পরামর্শে কান দেয়নি প্রায় কোনও হাসপাতালই।“ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪/৯/২০) সুতরাং গত ২২ অগাস্ট স্বাস্থ্য কমিশনের পরামর্শ ও সুপারিশের আদেশকে কার্যত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এখনও খরচের তালিকায় পরিষেবা ফি-র বিস্তারিত তথ্য জানানো হচ্ছে না, পাশাপাশি রিসেপশন ডেস্ক, ক্যাশ কাউন্টার এবং হাসপাতালের প্রবেশপথে ডিসপ্লে বোর্ড লাগানো হয়নি। এপোলো গ্ল্যেনিকেলস থেকে শুরু করে ডিসান, রুবি, আমরি, ফোর্র্টিস, সি এম আর আই সর্বত্র একই চিত্র।

শুরুটা হয়েছিল ২০১২ সালে আমরি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দিয়ে। যথাযথ তদন্ত হয়নি। কেস ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। আমরি আজও বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর ভুয়ো সার্টিফিকেট ও হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা এবং মোটা অংকের ভূতুড়ে বিল তৈরি করে রোগী ঠকানোর ব্যবসায় ফেঁসে গিয়েছিল একাধিক নার্সিংহোম ও বেসরকারি হাসপাতাল। এপোলো গ্লেনিকেলস – র তৎকালীন ডিরেক্টর “সম্পূর্না“ (তিনি এই নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন) -কে  অবিলম্বে পদচ্যুত করে বিতর্কিত পরিস্থিতি কোনোরকমে সামাল দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে আই ওয়াশ মার্কা ধমক ছাড়া, এমন গর্হিত অপরাধের কোনো কঠোর শাস্তি হয়নি। সুতরাং লোক ঠকানোর ব্যবসা ও পরম্পরা আজও অব্যাহত। করোনা অতিমারির ক্ষেত্রে আজ তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত বারবার গর্হিত কাজ করেও লজ্জিত নয় এরা। সম্প্রতি ডিসান আবার কাঠগড়ায়। “১৯ ঘন্টায় লাখ টাকা!“ (আজকাল, ২৬/৯/২০) মাত্র ১৯ ঘন্টা ভর্তি ছিলেন রোগী। বিল ধরানো হোলো ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৪৭৮ টাকা। গোজামিল ছিল বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট এবং প্যাথ বিলে। একই রক্ত পরীক্ষার ভিন্ন দর কেন সে নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। কবে হুঁশ ফিরবে? এটা বাস্তব সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো ও পরিষেবা পর্যাপ্ত নয় করোনা আক্রান্তদের সঠিক ও যাবতীয় সেবাদানের ক্ষেত্রে। সেখানে বেসরকারি হাসপালগুলোর উপর নির্ভর করতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে সরকারি বাধানিষেধ আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অমান্য করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। পাশাপাশি এই চরম সংকটকালে ব্যবসা ও বিভাজন ভুলে আরও মানবিক হতে হবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours