ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

মানুষ প্রাচীনকাল থেকে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাস করতে ভালবাসে। তখন সেটা ছিল নেহাৎ প্রয়োজন। কারন প্রাচীনকালে মানুষ বনে জঙ্গলে বাস করতো। ঘরবাড়ি ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল না। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করেই কেটে যেত জীবন। একটু অসাবধান হলেই প্রান হারাতে হতো। তাই বনে হিংস্র পশুর হাত থেকে নিজেদের প্রান রক্ষা করতে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতো। প্রত্যেক দলের সদস্যরা একই নিয়মে জীবন-যাপন করতো। সময়ের পরিবর্তে মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে অনেক কিছু যেমন আবিস্কার করেছে। তেমনি জীবন-যাপনে এনেছে অনেক পরিবর্তন।এই পরিবর্তনের পেছনেও কিছু যুক্তি আছে।

পৃথিবীতে সবকিছুই তার নিজস্ব যুক্তিতে চলে। প্রতিটা মানুষও তার নিজস্ব যুক্তি নির্ভরশীল। মানুষ খুন করে, আমরা তাকে খুনি বলে সনাক্ত করি। মানুষ খুনি দেখলে ঘৃনা করে। আসলে কি মানুষ সব অন্যায় দেখলে ঘৃণা করে? হয়তো না।কোথাও কোন ঘটনা দেখলে, সেটা ন্যায় বা অন্যায় ঘটনাই ঘটুক। সেখানে মানুষ দুইটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এক দল পক্ষে, একদল বিপক্ষে। তা না হলে খুনির হয়ে আদালতে লড়তে কোন আইনজীবি পাওয়া যেত না। নিজের মক্কেলকে নিরাপরাধ প্রমান করতে একের পর এক যুক্তি-তর্ক করে যায় মহামান্য বিচারপতির সামনে। যদি আইনজীবি যুক্তিতে টিকে যায় তাহলে খুনিও মাঝে মাঝে নিরাপরাধী হয়ে বেকসুর খালাশ পায়। আর যদি প্রতিপক্ষ যুক্তি-তর্ক ভাল হয় তাহলে খুনিকে আদালতের নিয়মে শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এই দুর্ধর্ষ খুনির কাছে যখন আপনি জিজ্ঞেস করবেন কেন খুন করেছিল? উত্তরে সে তার নিজস্ব যুক্তি উপস্থাপন করবে। তাৎক্ষনিক তার কথা শুনে আপনার মনে হবে, হ্যাঁ কাজটি সে ঠিকই করেছে। অপরাধ করে অনেক দোষী আদালতে নিরাপরাধ প্রমানিত হয়। তার মানে এই নয় সে সত্যি নিরাপরাধ। প্রত্যেকটা মানুষের দুইটি চরিত্র থাকে। একটি ভাল, অন্যটি খারাপ। কোনও মানুষ সারাজীবন ভাল কাজ যেমন করতে পারে না। তেমনি খারাপ কাজও করতে পারে না। একজন মানুষ কর্মক্ষেত্রে খুব ভাল, সুনাম আছে। হয়তো সে ভাল পিতা নয়। আবার অনেক ভাল পিতা সব সময় ভাল মানুষ হতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায় সন্তানের সুখের জন্য অনেক পিতা মানুষ খুন করে। কখনো দেখি চুরি করে। তাতে আমরা কি বুঝতে পারি এই মানুষগুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা চরিত্র অন্যরকম?

মানুষের বিবেক হচ্ছে তার আদালত। আর নিজস্ব যুক্তি হচ্ছে তার আইনজীবি। ভালকে যদি হারানো যায় তাহলে তিনি খারাপ কাজ করতে মনস্থির করেন। আবার মন্দকে যদি হারানো যায় তাহলে ভাল কাজ করার জন্য উৎসাহিত হন। এ জন্য মাঝে মাঝে খারাপ মানুষকেও ভাল কাজ করতে দেখি। আবার ভাল মানুষকেও খারাপ কাজ করতে দেখি।

পৃথিবীতে মানুষ নিজস্ব যুক্তিতে নিজে যেমন অন্যায় করে, আবার অনেক সময় অন্যকেও অন্যায় করতে উৎসাহিত করে। স্যোসাল মিডিয়াতে মাঝে মাঝে ঘোরাফেরা করতে থাকে কতো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এমন কতো ঘটনা ঘটে তা কেন, কি কারণে ঘটে বা তার গভীরতম উৎসইবা কোথায় তা আমরা কখনো খুঁজে দেখি না।

একবার খবরে প্রকাশ হলো, প্রকাশ্যে উলঙ্গ হয়ে একটি মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে এক ছেলে। আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে সন্তানকে শক্তি, সাহস যুগিয়েছে তার গর্ভধারিনী মা। যুগে যুগে আমরা মেয়েদের শত্রু হিসাবে পুরুষদের দোষারোপ করে এসেছি। অথচ এই ঘটনাটি যদি একটু মনোযোগ দিই তাহলে দেখতে পাই, মা তার ছেলে সন্তানকে একটি মেয়েকে ধর্ষণের জন্য উৎসাহ যুগিয়েছে। এখানে মুলত লড়াই হচ্ছে একটি মেয়ের বিরুদ্ধে অন্য একটি মেয়ের। মাঝখানে ছেলে সন্তানটি দাবা খেলার গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা খালি চোখে অনেক কিছু দেখতে পাই না। ছোটবেলা থেকে আমি একটু অনুসন্ধানী ধরণের। পুতুলনাচ দেখে মনে হতো পুতুলরা কি করে নাচে, হাঁটাচলা করে, কথাবলে।   

বড় হয়ে একবার পুতুল নাচের রহস্য দেখতে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম আসলে পুতুলের কোন কার্যক্ষমতা নেই। মানুষ সুতোর সাহায্যে সব কিছু করে। মানুষ আর পুতুলের মধ্যে সুতো হচ্ছে সেতুবন্ধন। কিন্তু দর্শক যখন পুতুল নাচ দেখে, তখন সুতো অদৃশ্য থাকে। এই সুতো এখানে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। সুতো দেখা না গেলেও তার অস্তিত্ব অনুভব করতে হয়। অথচ আমরা দেখতে পাই না। নিজের অজান্তেই আমরা অনেক অন্যায় করে ফেলি। হয়তো তাৎক্ষনিক এই খারাপ কাজের ফলাফল চোখে পড়ে না। তাই বলে ফলাফল থেমে থাকে না। পরবর্তী কোন এক সময় খারাপ কাজের ফল সামনে আসে। তখন আপসোস করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। তখন এই ফল জন্মানো রোধ করতে, পুরো গাছটাই কেটে ফেলতে হয়।

পরিবার অনেক বড় স্কুল। যেখানে সন্তান প্রথম শিক্ষা লাভ করে। যার প্রধান শিক্ষক মা। সুতরাং সমাজ বদলাতে প্রথম এবং প্রধান শিক্ষার দরকার পরিবারের মায়েদের। শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য পিটিআই ট্রেনিং দরকার। তেমনি প্রত্যেকে দম্পত্তি সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে তাদের একটা ট্রেনিং নেওয়া দরকার ভাল সমাজ গঠনের জন্য। আপনার আমার সন্তানই এ দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের সুন্দর নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। সব সময় যদি দৃশ্যমান বিষয় নিয়ে যুক্তি-তর্ক করি, তাহলে অদৃশ্য বিষফল থেকে আমাদের অজান্তেই বিষবৃক্ষ জন্মাতে থাকবে। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours